বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপি রেহানা আক্তারের বক্তৃতাটি সংবাদপত্রের পাতায় পড়ার সুযোগ হয়েছে। প্রথমে একটু বিস্ময়, মন খারাপ হলেও পরে তা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি।
না হলে, বিএনপিতে অনেক ত্যাগী নারীনেত্রী থাকতে খালেদা জিয়া খুঁজে খুঁজে এদেরকে কেন এমপি করবেন? দলে সেলিমা রহমানের মতো আরও অনেকে থাকতে রেহানা আক্তাররা কেন খালেদার নিযুক্তি পাবেন? অনেকের মতে, সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়গুলো দেশের নারীর ক্ষমতায়নের চাইতে এরশাদ তার বান্ধবীদের কথা মনে করে চালু করেছিলেন। তাদের একজন একবার আমাকে সরাসরি বলেছিলেন, স্যার (এরশাদ) আমাকে লাইক করেন, তাই আমি এমপি হয়েছি। এটা তিরিশ সেট বলেন আর যাই বলেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এরশাদের পর গত দুই দশকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি অনেক ত্যাগী নারীচরিত্রকেও এক্ষেত্রে সুযোগ দিয়েছে ঠিক, কিন্তু এসব রেহানা-আশিয়া-শাম্মীদের কদর-দাপট এখনো রয়েই গেছে। কেন তা হচ্ছে তার উত্তর তাদের নিয়োগকর্ত্রী নেত্রীরাই ভালো দিতে পারবেন।
রেহানার একটা বিষয় আমার কাছে খুব আপত্তিকর মনে হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা তিনি করতে পারেন, আমরাও করি। কিন্তু ‘তার বিশ্রী হাসি দেখলে মানুষ টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়’-- এটা কী রকম ভাষা? এটাতো পুরোপুরি রেসিজম। আইন প্রণেতা একজন সংসদ সদস্য কি করে সংসদে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলতে পারেন? আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ যে সারাদিন সাদা চামড়ার মানুষ দেখলেই রেসিজম খোঁজেন, তাদের দেশেও এমন উক্তি করা এখন আইনত সম্ভব নয়। একজন এমপির পক্ষে তো প্রশ্নই ওঠে না। এমন রেসিস্ট বক্তব্য কেউ পার্লামেন্টের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে দিলে স্পিকার তা একপাঞ্জ করলেও মাফ পাবার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে যেতো আইনের জিম্মায়। বিবেকের তাড়নায় বা বাধ্য হয়ে তাকে পদত্যাগ করতে হতো। নতুবা তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতো তার নিজের দল।
আমাদের দেশটাও এমন আজকের মতো ছিলো না। রাজনীতি এখন খুব বাজে একটা জায়গাও চলে গেছে তো! তাই রেহানার নেত্রীও প্রতিপক্ষকে ‘লুলা ল্যাংড়া’ করে দেবার কথা বলে দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন! সে নেত্রীর সাগরেদ রেহানারাতো এমন বলতেই পারেন। বিএনপি আবার তো আল্লাহওয়ালাদের দল। কোনো ধার্মিক মানুষও কি এমন মন্তব্য করতে পারেন?
দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এদের কেউ ১/১১ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন! দেশটার এমন দুর্ভাগ্য যে, রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক কীটপতঙ্গদের দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ মানুষজন একপর্যায়ে ১/১১’র মতো অরাজনৈতিক শক্তির আগমনেও কিছুদিনের জন্য যেন স্বস্তি পান। তখন তারা মজা করে দেখেন, কথিত দাপুটে নেতারা সব পালাচ্ছেন। এমন লোকজনকে তারা গ্রেফতার হতে দেখেন, যাদের গ্রেফতার করা যেতে পারে, এমন ধারণা বা বিশ্বাসও তাদের যেন ছিলো না! তারা অবাক হয়ে দেখেন, ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কারও আগমন সংবাদে একদার প্রভাবশালীরা ত্রাণের ঢেউটিন লুকাচ্ছেন পুকুরে! দেশের মানুষ পুকুরে মাছের চাষ করেন। কিন্তু ১/১১ এলে সেগুলো সেচে মেলে শুধু ঢেউটিন! তেমন অগণতান্ত্রিক শাসন আমরা কেউ আর চাই না। কিন্তু কী করলে ১/১১ আসে তা দেখেও তাদের হুঁশ হয় না!
কয়েক বছর আগে সংসদের কার্যবিবরণী যখন বেতারে (রেডিওতে) প্রথম লাইভ প্রচার শুরু হয় তখন একটি রিপোর্টিং- এর কাজে আমি মেহেরপুরে। মুজিবনগরের কাছে এক গ্রামের বাজারের চায়ের স্টলে বসে লোকজন সংসদের গালিগালাজ শুনছিলেন আর নানা কটু মন্তব্য করছিলেন। আমাকে তাদের একজন তখন বলেন, যখন গালিগালাজ শুরু হয় তখন আমরা একজন আরেকজনকে বাড়ি থেকে ডেকে আনি আর বলি, শোন আমাদের এমপি সাহেবরা যে বিশ্রী ভাষায় একজন আরেকজনকে গালিগালাজ করেন, এতো বিশ্রী ভাষা আমাদের মুখ দিয়েও বের হয় না। আমাদের ঘরের মেয়েছেলেরাও কৌতূহলবশত এসব গালিগালাজ শুনতে দোকানের পিছনে ভিড় করেন, আর লজ্জায় জিভ কাটেন! এত বছর পরেও বদলালো না দেশের রাজনীতি আর সংসদের চিত্র! দেশের মানুষ আগে বেতারে এসব গালিগালাজ শুনতেন, এখন লাইভ দেখছেন টেলিভিশনেও! সরকারিদল বিরোধীদলকে নাস্তানাবুদ করতে এসব আবার বারবার করে দেখাচ্ছে!
রাষ্ট্রপতির ভাষণের বক্তৃতা করতে গিয়ে রেহানা ওভাবে শুরু করেছিলেন কেন? এর সোজা কিছু উত্তর হতে পারে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে গেলে কেন সংসদে যায় না, বেতন-ভাতা ঠিক রাখার জন্য কি করে মাঝে মাঝে যায়, আবার কী ছুঁতোয় বেরিয়ে যায়, সে ধারাপাত সবার মুখস্ত। এই বিরোধীদলেরও অভিযোগ, সরকারিদল তাদের যা-তা ভাষায় আক্রমণ-তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এর জন্যে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা সংসদে যেতে-থাকতে পারেন না।
রেহানাকে দিয়ে কী রোববার সে গেমটাই খেলার চেষ্টা হয়েছে? তাহলে বলতে হয়, সরকারিদল রোববার অন্তত সংযম দেখিয়েছে। বিএনপির পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। কিন্তু এরপরও সবাই জানেন, বিএনপি সংসদে থাকবে না। আবার চলে আসাতে পরবর্তী নব্বই কার্যদিবসের জন্য বেতন-ভাতা নিরাপদ হয়ে গেল! এখন আজ হোক কাল হোক, সরকারি দল যত গৌতম বুদ্ধের অহিংস ভাব দেখাক অথবা ‘যেও না সাথী’ বলে গান ধরুক না কেন, তারা এখান থেকে বেরিয়ে যাবেই। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ সিট নিয়ে এখানে বেশি আইনি বাকোয়াজির সুযোগও তাদের নেই। আগামীতে আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে গেলে তারাও তাই করবে। অতএব একটি কঠিন কথা বলি? আসলে বাংলাদেশে যতোদিন এই দুই নেত্রীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব চলবে সংসদে ততোদিন এসব চলবে। কারণ, এই দুই নেত্রীর জন্ম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী-সংসদনেত্রী হবার-থাকার জন্য। বিরোধীদলের নেত্রী হবার জন্যে নয়। জনগণ যখন তাদের ভোট দেয় না, তখন তারা পদ-সুযোগ-সুবিধা রক্ষার জন্য বিরোধীদলের নেত্রী হন। সংসদে না গিয়ে বেতন-ভাতা নিয়ে হজম করে তারা সেই ভোটদাতা জনগণকে নাস্তানাবুদ করেন।
রেহানারা এসব কেন করেন? এরও উত্তর অনেক হতে পারে। এর কঠিন উত্তরটি হলো, মেধার সংকট। সুশিক্ষিত মেধাবী লোকজন একটু নম্র-ভদ্র হন। চাইলেই যা খুশি করতে পারেন না। এই মেধার সংকট এখন দেশে সর্বগ্রাসী। সমাজে-রাজনীতিতে-প্রশাসনে-মিডিয়ায়, সবকিছুতে। সর্বত্র এখন দলবাজ, তেলবাজ, আত্মীয়বাজ, টাকাবাজদের দাপট! এদের দাপটে মেধাবীরা কোনঠাসা! সে কারণে এ ধরনের বক্তৃতা দিতে পারাই রেহানাদের এমপি হবার যোগ্যতা!
দলবাজ-তেলবাজদের দাপটের কারণে রাজনীতি-সরকার-প্রশাসন সবকিছু চলছে খুঁড়িয়ে! পত্রিকায় ক`দিন পরপরই প্রশাসনে গতি না আসার একটা রুটিন-রিপোর্ট ছাপা হয়। `কাঁঠাল গাছে যে আম হয় না’, তা আমার মতো যেন ভুলে যান সবাই! দেশের সব গোয়েন্দা মিলেও সাগর-রুনির খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেন না। কারণ, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এদের বেশিরভাগই তো কোথাও নিজস্ব যোগ্যতায় পদ পাননি। পেয়েছেন টাকায়-তেলে অথবা দলে।
সমাজের এসব পাপ-তাপ-নৈরাজ্য ধারণ করে মিডিয়ার অবস্থা-অবস্থান এখন কোথায় তা-ও আর কারো কাছে লুকোছাপা নেই। রেহানাকেও সেভ করার জন্যে দেখবেন দলবাজ মিডিয়া দাঁড়িয়ে যাবে অথবা ইতিমধ্যে দাঁড়িয়েও গেছে!দুর্নীতিবাজ-তেলবাজ-দলবাজ-মেধাহীনদের উল্লাসের নৃত্যের মধ্যে শুধু ‘এই দিন দিন না/ আরও দিন আছে’ জাতীয় সান্ত্বনা পুরস্কারের সংলাপ আওড়ানো ছাড়া জিম্মি-অসহায় দেশবাসীর আপাতত কিছুই করারও নেই!
ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
চূড়ান্ত সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর