ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

যেভাবে সমাহিত হয় ঢাবি’র একেকটি আন্দোলন!

আব্দুল আলীম ধ্রুব, অতিথি লেখক ও সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১২
যেভাবে সমাহিত হয় ঢাবি’র একেকটি আন্দোলন!

প্রথমেই আসি সাজানো আন্দোলন, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও আন্দোলন সমাহিত করার পিছনে যে ব্যাপারগুলো কাজ করে সেপ্রসঙ্গে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে গভীর রাতে একটি `ফেসবুক আন্দোলন`কে সাজানো হয়েছিল এক বহিরাগত সাংবাদিকের নেতৃত্বে এবং তাতে ঘটনার আকস্মিকতায় সাংবাদিকতা বিভাগের জুনিয়র শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে তা তখন অনেকের কাছেই পরিস্কার না হলেও এখন দিনের সূয্যের মতো জ্বলজ্বল সত্য ।

সিনিয়ররা ডাকলে আমাদেরকে এভাবেই অনেকবারই যেতে হয়। না গেলে বারবার ফোন করে বিরক্ত করা হয়। আর জুনিয়ররাও ইচ্ছের বাইরে তাদের ডাকে যেতে বাধ্য হয়, কারণ- তারা মিডিয়াতে জুনিয়র ছেলে-মেয়েদেরকে চাকরি দিতে পারে। আর একটা চাকরিও আমাদের জন্য খুব কম দরকারি নয়।

আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্খার পরিপ্রেক্ষিতে ওই চাকুরীটাও যে আমাদের বড় দরকার। এটা আমাদের কারোই ব্যক্তিগত সমস্যা না। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা মেধার অবমূল্যায়ন আর সংস্কারের অভাবকেই নির্দেশ করে- আজকের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের বেঁচে থাকার তাগিদে একটা ছোট্র চাকুরীর জন্য মরিয়া হওয়ার প্রবণতা। তাছাড়া আর করবেই বা কি তারা!  আহামরি অংকের কোন টাকাও মেধাবীরা বৃত্তি হিসেবে পায় না যা দিয়ে সে নির্বিঘ্নে ভালো রেজাল্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। আমাদের উচ্চশিক্ষাটা কি এখন শুধু কর্মচারী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নাকি দেশের ভবিষ্যত কান্ডারীদের অসৎ রাস্তায় ধাবিত করার জন্য- তা নিয়ে প্রম্ন তোলার মতো সময় হয়েছে। শিক্ষাঙ্গণের ও সর্বোচ্চ মেধাবীদের এই দূর্বল অবস্থার দায় কখনোই রাষ্ট্র পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। শিক্ষা ব্যবস্থার নিম্নমূখীতার এ দায় কখনোই সমাজ অস্বীকার করতে পারে না। এর দায় অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এটা ভিন্ন কথা। বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা সম্ভব।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি, অধিকারের সাথে গণমাধ্যম-সরকার-গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও প্রশাসন। এটাই ছিল বিষয়। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের অংশটি এখানে দখল করে রেখেছে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও সংবাদ কর্মীরা। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপতৎপরতা চালানো এমন সিনিয়র সাংবাদিক যে খুব বেশী তা কিন্তু নয়, আপনারা দয়া করে সব সাংবাদিককেই আবার এমন ভেবে বসবেন না। খুব কাছে থেকে বিগত চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- এমন লোক দু`তিন জনের বেশী দেখিনি আমি। বিভাগের বড় ভাই হিসেবে, খেলার মাঠের সহখেলোয়ার হিসেবে, বিভিন্ন মিডিয়াতে কাজের সুবাদে সহকর্মী হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বড় বড় সাংবাদিকের ঘনিষ্ঠ সাহচার্য পেয়েছি। তাদের কাছে কাজ শিখেছি। তারা নিজের কাজের অবসরে ঠিকই হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছেন আমাকে। এভাবে তারা শুধু আমাকে না, বিভাগের ছোট ভাইবোন, অফিসের সহকর্মী সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।   কোনদিন তারাতো নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য আমাদেরকে কখনো কোন হুকুম করে নি। এটাই সত্য, তারা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে আনন্দ পান। তাই তারা স্বার্থছাড়াই হয়তো মঙ্গল কামনা করেন। আর গণমাধ্যমের কর্মীরা নিজেদেরকে একটা পরিবার মনে করে হয়তো এজন্যই। কিন্তু সব পরিবারেই যেমন  কিছু পথভ্রষ্ট থাকে, তেমনি আমাদের সাংবাদিক পরিবারেও তেমন কিছু নষ্ট মানুষ আছে। যাদের জন্য সাংবাদিক সমাজটাই কলুষিত হয়ে থাকে।

এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে কয়েকহাজার টাকার একটা চাকুরী নিয়ে দেন। বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই প্রতিদিন ক্যাম্পাসে এসে এরা জনসমাগম করেন। দিন দুপুর হোক আর মধ্যরাত হোক- এরা ক্যাম্পাসে আসার আগে ফোন দেন।

সেই ফোন পেয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীদেরকে মধুর ক্যান্টিনে বা টিএসসিতে তাদেরকে প্রটোকল দেয়ার জন্য উপস্থিত থাকতে হয়। এই আনুগত্যের বিন্দু পরিমান ঘাটতি হলে এই `রাজনৈতিক সংস্কৃতির` সাংবাদিকদের `গুড বুক` থেকে কাটা পড়ে যায় জুনিয়র শিক্ষার্থীরা। আর এই ভয়েই এবং ক্যাম্পাসে নিরাপদে থাকার আকাঙ্খায় জুনিয়র শিক্ষার্থীরা মুখ বুঁজে সহ্য করে সবকিছু। আর এমন একটা পরিস্থিতিতে- লোকসম্মুখে তারা নিজের পক্ষের লোকবল হিসেবে জুনিয়রদেরকে প্রদর্শণ করে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শণ করে। তারা আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঘনিষ্ট লোক হওয়ায়- মন থেকে না হলেও ভয় পেয়ে মুখে অন্তত সালাম দেয় মানুষ তাদেরকে। আর ক্ষমতাশীল ছাত্র নেতাদের সাথে তাদের সম্পর্কটাও বেশ উষ্ণ। এজন্য তারা ছাত্রনেতাদের মতো ক্ষমতার একটা আলখেল্লা চাপিয়ে চলতেও পছন্দ করেন। পারস্পারিক সম্পর্কের আওতায় এভাবেই একটা কূচক্রীমহল গড়ে ওঠে সমাজে। আর তারা ভূমিকা রাখেন শুধু নিজেদের স্বার্থে। অর্থ্যাৎ তাদের জ্ঞানের বাইরে কিছু ঘটলেই তারা তাদেরকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে উল্টা-পাল্টা বকতে শুরু করেন। আর প্রশাসনের ইচ্ছানুযায়ী তারা তখন তাদের মতো করে গুজব ছড়াতে থাকে। প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে তারা এভাবেই নিজেদের সাজানো নাটক মঞ্চায়ন করে। সংখ্যালঘু এই নোংরা রাজণীতিবিদরা ও কতিপয় জ্ঞানপাপী মিলে বিভিন্নভাবে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ রাখছে। এক্ষেত্রে তারা একটি একাডেমিক `তত্ত্ব` অনুসরণ করে যাচ্ছে। বাংলায় একে বলে `নিরবতার কুণ্ডলী তত্ত্ব` আর ইংরেজীতে এর নাম `স্পাইরাল অব সাইলেন্স`। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো- দুই দল মানুষ থাকে সমাজে। একদল ক্ষমতাবান আর অন্যদল আমজনতা বা সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ যখন দেখে যে, ক্ষমতাবানরা কোনকিছু জোরগলায় বলছে তখন তারা তা মেনে না নিলেও প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকে। এটা ক্ষমতার কাছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জনিত অদৃশ্য একটা সংশয়। আর এই সাধারণ মানুষরা যখন চুপ থাকে তখন ক্ষমতাবানদের অল্প কয়েকটি কথাই বারবার শোনা যায়। এভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদেরেকে কৌশলে নিরব করে দিয়ে চালানো হয় `প্রোপাগান্ডা মিশন`।

এখন যেমন `শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের` ছাত্রসংসদ বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রচারণা ও অবিলম্বে ডাকসু সচল করার দাবির অধিকার আন্দোলনকে তারা বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আর এ কাজটা করছে তারা প্রাপাগান্ডা ছড়িয়ে । তাহলে এখন পরিস্কার করে বলি যে- প্রাপাগান্ডা জিনিসটা কি? ইচ্ছাকৃতভাবে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোন প্রচারণা চালানোই হলো প্রপাগান্ডা। এবং বৃহতভাবে সফল না হলেও তারা অতিক্ষুদ্র একটা বৃত্তের মধ্যে এই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে থাকে। এসব প্রোপাগান্ডায় বিস্তারিত কোন তথ্য থাকে না, থাকে সব ভাসা ভাসা তথ্য- যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় মাত্র। এবং আমার মনে হয় আমাদের উপাচার্য মহোদয়ের সরাসরি সম্মতি থাকে তাদের এসব অপকর্মের প্রতি! আর সম্মতি না থাকলেও নিশ্চই অসম্মতি থাকে না! এটা অবশ্য আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। কারণ উপাচার্য মহোদয়ের বাসাটাকে `পাওয়ার হাউস` হিসেবে বিবেচনা করেই তারা যে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন! বিশ্বাস হচ্ছে না! তাহলে আরো একটু খুলেই বলি।

ক্যাম্পাসে ডেইলিস্টার-প্রথমআলো পোড়ানোর পর যা হলো---

ক্যাম্পাসে একবার প্রথমসারির একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা পোড়ানো হলো। হলুদ সাংবাদিকতার প্রতিবাদে `অপরাজেয় বাংলা`র সামনে পত্রিকা দুটি পোড়ালো `যোগাযোগ ইশকুল` নামক যোগাযোগ ভিত্তিক একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেই ঘটনা মনে আছে কি আপনাদের । ঘটনাটি ঘটে গ্রামীণ ব্যাংকের ইস্যুতে ড. ইউনুসকে নগ্নভাবে সমর্থন দেয়ার জন্য! জানিয়ে রাখি যোগাযোগ ইশকুলটা কি- যোগাযোগ ইশকুল নামে একটি সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান আছে ক্যাম্পাসে। মজার ব্যাপার হলো এই সংগঠনটি ক্ষমতাশীল ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর কারণ অবশ্য গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। এছাড়াও যোগাযোগ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাথে সংগঠনটির সংশ্লিষ্টতা। যোগাযোগকে যে বড়ই ভয় পায় কূচক্রীরা!  যাইহোক, যা বলছিলাম- পত্রিকা পোড়ানোর পর যা হলো তা আমার কাছে এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। আমি একের পর এক অবাক হতে থাকলাম পরিচিত মানুষগুলোর অপরিচিত আচরণে।

এখন সে কথাই বলছি- সাংবাদিক সমিতির প্রগতিশীল লোকদের সাথে সেদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম টিএসসিতে । প্রগতিশীল বলার কারণ হচ্ছে, ওই সমিতিতে প্রকাশ্য দুটি আলাদা গ্রুপ আছে। গ্রুপের ভিতরে আরো অনেক গ্রুপ আছে সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা। যাই হোক, প্রধান দুই গ্রুপের একটা হলো আওয়ামীঘেঁষা ও আরেকটা হলো বিএনপি-জামাত ঘেঁষা। এই আওয়ামী প্যানেলের সংবাদকর্মীরাই নিজেদেরকে প্রগতিশীল বলে দাবি করে। আর এদেরই এক নেতার সাথে আমি সেদিন উপাচার্যের বাসায় যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য নেতাসাহেব তখন জোর তদবিরের সম্পর্ক চালাচ্ছিলেন ভিসির সাথে। তিনি ভিসিকে অভিযোগ জানিয়ে বললেন, `স্যার ক্যাম্পাসে তো `আমাদের` পত্রিকা পোড়ানো হয়েছে। আফিসে এটা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এর ফলে ডিপার্টমেন্টের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। `

আমি একটু চমকে গেলাম তার কথা শুনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী যদি নিজ দায়িত্বে কিছূ করে তাহলে ডিপার্টমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেন! সেটা আমি আজও বুঝি না। আর কাজটাতো ডিপার্টমেন্টের ব্যানারেও হয়নি! তাহলে!! প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করার অধিকার আছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে তা অবশ্যই থাকা উচিত। সবকিছুর মধ্যে ডিপার্টমেন্ট, চাকরি এসব বিষয় টেনে আনা উচিত নয়। যাই হোক, ভিসি মহোদয়ও সেদিন বেশ উষ্মা প্রকাশ করলেন। তিনিও বললেন, `গণযোগাযোগের শিক্ষার্থী হিসেবে পত্রিকা পোড়ানোটা উচিত হয়নি। `

আমি আরো একবার অবাক হয়ে গেলাম। এটাই কি আমাদের সেই গণযোগাযোগের বিখ্যাত শিক্ষক!  যিনি কথায় কথায় আমাদেরকে মুক্তমনা হওয়ার পরামর্শ দিতেন! ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন ব্যাপারটা একটু। আগে তো একজন লোক রাষ্ট্রের নাগরিক। একজন নাগরিক তার অভিমত জানাতে চায়, প্রতিবাদ করতে চায়- এটা অবশ্যই তার অধিকার। তারপর না হয় পুরুষ-নারী, শিক্ষার্থী বা চাকুরিজীবী, আরো অনেক পরে আসে সে কোন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী।

সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছি মহোদয় ভিসি`র একথা শুনে। আমার অবাক হওয়া বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না আরো বড় চমকের বিস্ফোরণে। আমার পাশে বসে থাকা সেই সাংবাদিক নেতা মোলায়েম কন্ঠে ভিসি মহোদয়কে বোঝানোর সুরে বলতে লাগলেন- `স্যার, ক্যাম্পাসে এই পত্রিকাগুলো পোড়ানোর জন্য দেশের একটা বড় গ্রুপের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা পেয়েছে আন্দোলনকারীরা। `

স্যার তো মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি নেতার দিকে আর মনে মনে ভাবছি কী অলুক্ষণেই না আজ এই লোকের সাথে এখানে এসেছিলাম! তার কথা শেষ হবার পর আমি স্যারকে তিনজন ব্যক্তি সম্পর্কেই আমার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেছিলাম। তবে ভিসি কিংবা নেতা দুজনই খুব বেজার হয়েছিলেন সেদিন আমার উপর। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল তারা তিনজনই প্রতিষ্ঠিত উদীয়মান সাংবাদিক। তারা ক্যাম্পাসের সাংবাদিক সমিতি এবং জ্বীহুজুর সিন্ডিকেটের বাইরের জুনিয়র ছিল তখন। তারা কারো আগেও নাই, পিছেও নাই। এজন্যই তাদেরকে কলংকিত করে ক্যাম্পাসে নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্যের মহড়া দিতে চেয়েছিলেন সেদিন এই সাংবাদিক নেতা, এখন অবশ্য তিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেছেন। তবে সাময়িকভাবে কয়েকদিনের জন্য এ প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলেও ক্যাম্পাসের আপামর শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত ভিসিভবন থেকে তৈরি হওয়া ষড়যন্ত্রের এ অভিযোগ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সৎ সাহসের প্রতিফলন দেখানোর জন্য অনেক মানুষ দূর থেকে আন্দোলনকারীদেরকে শ্রদ্ধাও জানিয়েছে।
সত্যের জয় হয়েছে তখনও। অপচেষ্টাকারীদের `ব্লেম গেম` অল্প সময়ের জন্য বিতর্ক সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত দুরন্ত, সাহসী ও তারুণ্যের সততার কাছে `চাটুকার ও ধান্দাবাজি`র পরাজয় হয়েছে।

এই বাস্তব কথাগুলো বলার ইচ্ছা ছিল না। বলতে বাধ্য হলাম `ব্লেম গেম` কি তা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্য। কিভাবে ক্যাম্পাসে এখন `ব্লেমগেম` কাজ করে এবং কারা এই নোংরা খেলাগুলো পরিচালনা করে তার একটি বাস্তব দৃশ্যচিত্র তুলে ধরার জন্য।

আরেকটি দৃশ্যচিত্র দেখাই। সাজানো আন্দোলন দেখলেন, কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথাকে থামিয়ে দেওয়া হয়, গোলামী না করলে কিভাবে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে নোংরা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়-তাও দেখলেন। এবার অন্য একটি দৃশ্য দেখুন। কিভাবে আন্দোলনগুলোকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়-সেটা জানুন।

ক্যাম্পাসে ইভিনিং শিফট কোর্স চালু করার বিরুদ্ধে, বেতন ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধ, পরীক্ষার রেজাল্টের দাবিতে অনেকগুলো আন্দোলন হয়েছে এখন পর্যন্ত। তবে আন্দোলন গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রশাসন সব বিভাগেই কমবেশি অপকৌশল প্রয়োগ করছে। বছর দুয়েক আগে, আমি তখন একটা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ কাজ করি, ইংরেজি বিভাগে মার্শাল ল এর মতো অবস্থা জারি হয়েছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর। এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাংবাদিককে তুই/তোকারি করে গালমন্দ করেন এবং রুমে বন্ধ করে রাখার হুমকিও দেন। পরে এটা নিয়ে সঙবাদও প্রকাশ হয়। এটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের চেয়ারম্যানের কাজ হতে পারে!! এজন্যই বলি শিক্ষকরা নিজেদেরকে দেবতার আসনে নিয়ে গেছেন আর শিক্ষার্থীদেরেক ভাবছেন হুকুম পালন করার গোলাম মাত্র। তারা ভূলে গেছেন যে- শিক্ষাদান একটা মোহহীন সেবামূলক মহান পেশা। আর এই পেশা যখন ক্ষমতার উত্তাপে টগবগ করতে থাকে, অনেক পয়সা আয়ের নেশায় অন্ধ হয়ে যায়, যখন ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি দায়সারা জবাব দেয় তখন অবশ্যই জাতির ভবিষ্যত নেতৃত্ব মুখ খুবড়ে পড়ে । মানুষের সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি পায়, শেখার আশায় পিটপিট করে তাকিয়ে থাকা চোখগুলো আশাহত হতে হতে মাদকাসক্ত হয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সময় কাটায়।

সেসব কথা থাক এখন, পরে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার হলো গণযোগাযোগ বিভাগের ইভিনিং শিফট বিরোধী আন্দোলনটা। সেটাও কিন্তু কয়েকধাপে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
সাংবাদিকতা বিভাগের ইভিনিং-শিফট বিরোধী আন্দোলন...

এই ঘটনার সময় আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম না। আমার ভর্তি হওয়ার প্রায় দুই বছর আগে এই আন্দোলন হয়েছিল। তবে সর্বসম্মতভাবে ডিপার্টমেন্টের সব সিনিয়র ব্যাচের কাছেই যা শুনেছি তাতে গেলে ব্যাপারটা এমনই দাঁড়ায় যে- আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ স্বতস্ফূর্ত। ইভিনিং শিফট চালু করতে দেওয়া হবে না- এমন একটা সাধারণ সংকল্প থেকেই সবাই একসাথে রুখে দাঁড়ায় চাপিয়ে দেওয়া ইভিনিং শিফট কে। প্রায় তিন সপ্তাহের এই আন্দোলনে প্রকাশ্যভাবে কেউ ব্যক্তি হিসেবে এককভাবে নেতৃত্বে ছিলেন না। কিন্তু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বদল হয়েছে কয়েকবার। সিনিয়রদের একটা অংশ কয়ৈকদিন পর নিস্ক্রিয় হয়ে যান। আরো কয়েকদিন পর ভালো রেজাল্টধারীরা অংশগ্রহণ কমিয়ে দেন। আন্দোলন চালিয়ে নেয় তখন মধ্যম সারির শিক্ষার্থীরা।

আরো পরে মধ্যম সারির শিক্ষার্থীদেরও একটা অংশ উদাস হয়ে যায়। মধ্যমসারি বলতে আমি এখানে, অনার্স তৃতীয় বর্ষ টাইপের একটা সময় বা ক্লাসকে বোঝাচ্ছি। এর উপরের যারা তারা সিনিয়র এবং নিচেররা জুনিয়র। সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কিন্তু আন্দোলনটা চালিয়ে নিয়ে যায় বিভাগের জুনিয়র শিক্ষার্থীরা। আর তাদের সাথে অল্প কিছূ মধ্যম ক্লাসের সিনিয়র ছিলেন মূল ভূমিকায়। যাদের অনেকের ভূমিকাই এখন আর স্বীকার করা হয় না শুধুমাত্র রাজনৈতিক হিসাবের কথা মাথায় রেখে।

যাইহোক আন্দোলনটা কিন্তু সফল হয়েছিল। সিনিয়ররা বা কিছু ভালো রেজাল্টদারীদের উদাসীন্য, পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া, মনোভাব পরিবর্তন হয়ে যাওয়া- এসব কি আপনাআপনি ঘটেছিল বলে আপনারা মনে করেন! নাহ, এসব এমনি এমনি হয় নাই। তাদেরকে অবশ্যই কনভিনসড করা হয়েছিলো। আন্দোলনের মূল স্রোতৈই দুই-তিনবার পরিবর্তন হয়েছে। এটাই তো প্রশাসনের খেলা! কিন্তু এখানে সাংবাদিকতা বিভাগের জুনিয়রদের বলিষ্ঠতার মুখে প্রশাসন শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

এই আন্দোলন থেকে প্রশাসন অবশ্যই শিক্ষা নিয়েছে। আর সেই শিক্ষা হলো- শুধু সিনিয়রদের আশায় থাকলে সবসময় সুবিধা করা যায় না। আর সেজন্য গণযোগাযোগের একজন বিচক্ষণ অধ্যাপক সর্বোচ্চ প্রশাসক পদে মনোনয়ন পাওয়ার পরে প্রথমেই চেয়েছেন একটা সাজানো ও সুশৃঙ্খল বাহিনী। যেটা তার প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে আলাদা একটি অদৃশ্য কিন্তু কার্যকর বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। আর ক্যাম্পাসের সর্বোচ্চ প্রশাসকের ক্ষমতা পাওয়ার মতো `আখের মিষ্টি গুড়` হাতে পাওয়ার পরে তার পাশে অল্পসময়ের মধ্যেই জুটে যায় কিছূ মিষ্টি সন্ধানী পিঁপড়া। `গুড়ের` আশেপাশে যদি `পিঁপড়াই` না দেখা যায় তাহলেও তো ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়! যাই হোক, সেই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়েই চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এবং বিভিন্ন রকম মেকি প্রগতির বাণী ছড়িয়ে দিয়ে-ছলচাতুরী করে ঢেলে সাজানো হয়েছে আধুনিক একটি `গেস্টাপো` বাহিনী। যে বাহিনীর সামনে একের পর এক এজেন্ডা সেট করা থাকে। অথবা এজেন্ডা সেট করে এরা বারবার কাজের জন্য মাঠে নামে। তবে এদের সুকৌশলী আচরণের কাছে জুনিয়ররা অনেকেই মনের অজান্তেই পরিণত হয় এদের ব্যবহার্য জিনিসে ।

এই কথাগুলো বলার কারণ হলো,  এখন ক্যাম্পাসে কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী একটি আন্দোলনে মাঠে নেমেছে `শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের` ব্যানারে। গণযোগাযোগ, সংগীত, নাট্যকলা, চারুকলা, টিএসসির সাংস্কৃতিক সংগঠন, কিছু বাম দলের অংশগ্রহণ- এটাতো অনেক বড় প্লাটফর্মই মনে হয়। মাসখানেক সময় ধরে তারা গুছিয়ে উঠছে। তারপরেও আন্দোলন কিছুটা এলোমেলো মনে হয় মাঝে মাঝে। সেটা হয়তো মাথার উপর সরাসরি কোন মাফিয়া বা সিদ্ধান্তদাতা না থাকার কারণে। তাই তো হবে। সবার মতের সাথে মতের মিল হতে সময়টা একটু বেশিই লাগে। ফেসবুক আন্দোলনের মতো দশ মিনিটের মধ্যেই আন্দোলন করে মিডিয়া উল্টে দেওয়া যায় না- এটা যে পায়ে পায়ে ধূলো মেখে গড়ে ওঠা সবগুলো চেপে রাখা ঠোটের প্রতিবাদী উদগীরণ।

এটা যে সামগ্রীকভাবে একটি অধিকার আন্দোলন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রশাসনের কাছে দাবি উস্থাপন ও একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোতো তরুণ প্রজন্মের একটি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার প্রচেষ্টার আভাস মাত্র। সেটিকে কেন মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য এতোগুলো বহিরাগত মাঠে নামে! অবশ্যই এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এবার আসল কথায় আসি- `শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের` ছাত্র সংসদের কর্মকাণ্ড বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও ডাকসু নির্বাচনের দাবির প্রচারণা ও আন্দোলনকে নষ্ট করে দেয়ার জন্য উপাচার্যের সুবিধাপুষ্ট কয়েকজন সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাঠে নেমে চষে বেড়াচ্ছেন। এদের থেকে অবশ্যই সাবধান থাকার দরকার আছে। এরা নেমেছেন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। অ্যাসাইনমেন্ট সফল হলে এরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবেন এবং অতীতেও হয়েছেন।

কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের কপালে লাথি দিয়ে- মুষ্টিমেয় এদের কয়েকজনার কাছে আপনি জিম্মি হয়ে থাকবেন? নাকি নিজের বিবেচনায় সার্বিক বিষয় চিন্তা করে আপনার সিদ্ধান্ত আপনি নেবেন? একজন প্রাপ্তবয়স্ক সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি একান্তই ব্যক্তিগত।

বাংলাদেশ সময় ১১৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১২

লেখক: আব্দুল আলীম ধ্রুব, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।