বিপদে বন্ধুর ভূমিকায় খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান! সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বিবৃতিতে বলা হয়েছে খালেদার বিরুদ্ধে আইএসআইর টাকা নেবার অভিযোগ সত্য নয়। আসিফ দুররানি পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্টের শুনানিতে এমন কথা বলেননি।
এ ধরনের প্রচারণা দু’দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর দুরভিসন্ধি বলে বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়। অতএব এই অভিযোগের আঙ্গুলটি শেখ হাসিনার দিকেও। কারণ, দুবাই আর বিলাতের পত্রিকার রিপোর্টের সূত্র ধরে অভিযোগটি বেশি করেছেন শেখ হাসিনা। এমনকি খালেদাকে পাকিস্তান চলে যেতেও বলেছেন!
এখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য পাবার পর এ নিয়ে গলা চড়িয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শেখ হাসিনাকে তিনি ক্ষমা চাইতে বলেছেন। নইলে মামলা ঠুকে দেবার হুমকি দিয়েছেন! কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আইএসআইর টাকা নেবার অভিযোগ করেছিলেন, সে অভিযোগ বা এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে কিনা, সে বিষয়টি কিছু সুরাহা করেননি বা বলেননি।
খালেদার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি যে পাকিস্তান সরকার বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তা তাদের বিবৃতির বক্তব্যে স্পষ্ট। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস, সে দেশের সরকারি ছুটির দিন। দেরি না করে সেই ছুটির দিনটিতেই সরকারি বিবৃতিটি প্রচার করা হয়েছে। এরআগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছিলেন, তারা পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের নথি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল বক্তব্য পাবার পর পুরো বিষয়টি নতুন মোড় নিয়েছে।
মার্চের শুরুতে দুবাইভিত্তিক খালিজ টাইমসে প্রথম খবরটি বেরোয়। এরপর বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া গরম করতে থাকে! বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এর বিরুদ্ধে বললেও খালিজ টাইমসে এর কোন প্রতিবাদ পাঠাননি। খালেদাও ১২ মার্চের মহাসমাবেশের বক্তৃতায় অভিযোগটির জোরালো প্রতিবাদ না করাতে সন্দেহটি বাড়ে। এরপর বিলাতের ডেইলি মেইলের অনলাইন সংস্করণ, টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরের সূত্রে বাসস খবরটি পিক করলে এ নিয়ে আগুন প্রতিক্রিয়া হয়। এমনিতে খালেদা জিয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অভিযোগের অন্ত নেই। জিয়ার মৃত্যুর পর অসচ্ছল চিহ্নিত পরিবারটিকে সরকারিভাবে বাড়ি-ভাতার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। মামলা সংক্রান্ত কারণে খালেদার দুই ছেলে বিদেশে সপরিবারে থাকেন। তারা সে সব দেশে কোন চাকরি বা ব্যবসাও করেন না। কিন্তু তাদের বা পরিবারটির কোনো রকম অর্থনৈতিক সমস্যার কথা কখন শোনা যায়নি। এসব কারণেও আইএসআইর টাকার বিষয়টি বাজার পেয়েছে বেশি। যদিও বিএনপির একজন এমপি মন্তব্য করেছিলেন, এটি এমন কী পরিমাণ টাকা যে তা বিদেশ থেকে আনতে হবে!
পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সম্পর্কটি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! বিএনপির সরকার থাকতে সম্পর্কটি ভালো ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের চলতি বিচারেরও বিরোধী বিএনপি। পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো ১৯৩ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে মূল যুদ্ধাপরাধী বললেও তারা ক্ষমতায় গেলে ওই সৈন্যদের যারা জীবিত আছেন, তাদের ফেরত এনে বিচারের সম্মুখীন করার ঘোষণাও তাদের নেই। আইএসআইর টাকার বিষয়টি দেশে বাজার পাবার আরেকটা কারণ, বিএনপি-জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ নানা অঞ্চলে আইএসআই’র সক্রিয়তার খবর ওয়াকিবহালরা জানেন। মূলত ওই দুই আমলেই বাংলাদেশকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য করে তোলা হয়। মিয়ানমারের আরাকানে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় বান্দরবানের গভীর পাহাড়ে। নাইক্ষ্যাংছড়ির গভীর জঙ্গলে এখনও তাদের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়। বাংলাদেশ নিজের থেকে এমনিতে হাজার সমস্যায় জড়িত। এ অবস্থায় এসব করার সামর্থ্য-উর্বর মস্তিষ্ক(!) বাংলাদেশের নেই। ওয়াকিফহালরা জানেন, এর সবই চলছিল আইএসআইর ইন্ধন-উসকানিতে।
সেই থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি আরো বড় বিষফোঁড়ার মতো জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের নিয়তির সঙ্গে! এখন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্টে ছড়িয়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যেসহ নানা দেশে! তাদের অনেক অপকর্মের দায়দায়িত্বও বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগামে অশান্তির রূপকার হিসাবে আইএসআই’র ভূমিকা ওয়াকিফহালরা জানেন। এরজন্য বিএনপির শাসনামলে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। ভারতীয় চরমপন্থি নেতারা নাম পালটে ঢাকাসহ দেশের নানা শহরে সপরিবারে বসবাস করছিলেন। বাংলাদেশি পাসপোর্টে ঘুরছিলেন বিদেশ! এর সবই হয়েছে-চলেছে আইএসআইর পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপি-জাতীয় পার্টির শাসনামলে। সর্বশেষ খালেদার শাসনামলে ধরা পড়েছে ১০ ট্রাক অস্ত্র! আইএসআইর উদ্যোগে এসব অস্ত্র ভারতীয় চরমপন্থি উলফার জন্য আনা হয়েছিল। সমন্বয়ের অভাবে অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়ে যায়। এখন সে ঘটনায় জড়িত বাংলাদেশি রুই-কাতলাদের বিচার চলছে। কাজেই বিএনপির এমপি যে বলেছেন, আইএসআইর প্রচারিত পাঁচ কোটি টাকা এমন কী টাকা যে বিদেশ থেকে নিতে হবে? আসলেই নানাভাবে বাংলাদেশে আইএসআইর কার্যক্রম অনেকভাবে, এখানকার অনেককে নিয়েই সক্রিয় রয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কারণে এ অঞ্চলটি অফিসিয়ালি তাদের হাতছাড়া হলেও পচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর আইএসআই এ অঞ্চলে নতুন ভূমিকায় চলে আসে! এখানে তাদের লোকজনকে তারা আবার নতুন করে চিনে-খুঁজে নিয়েছে! তাই খালিজ টাইমস বা বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টকে কেন্দ্র করে উঠে আসা অভিযোগটি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির মাধ্যমে ঘুচে যাবে না। এটি শুধু বাংলাদেশ না, আফগানিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সম্পর্কের অভিজ্ঞতায় বলা চলে। এখনও তালেবানদের গোপন সহায়তার অভিযোগ আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর আইএসআইর বিরুদ্ধে। এ্যাবোটাবাদের সেনানিবাস এলাকার ভিতরে লাদেনের ঘাঁটি শনাক্তের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, সরকারের কথাবার্তাকেও কেউ বিশ্বাস করেনা। আইএসআইর টাকার দুর্গন্ধটিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে থেকে যাবে অনেকদিন!
ফজলুল বারী : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ১৯৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১২
সম্পাদনা : মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ