সিলেটের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য হতাশ করেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সারাদেশে এবং সিলেটে মানুষজনের কি উদ্বেগ তা এখনও যেন প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতারা বুঝে উঠতে পারছেন না! তাই এখনও দিয়ে চলেছেন, সেই ‘যদি’র বক্তৃতা! যদি’ টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে এই বাঁধ হতে দেবো না ইত্যাদি?
নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে বাঁধ দিলে তাতে কোথাও উপকার হয়, এমন একটি দৃষ্টান্ত কি প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দলের কোনো নেতা অথবা নদী বিষয়ক কোনো পণ্ডিতের সামনে আছে? ফারাক্কার কী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া চলছে গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়ে? কাপ্তাই বাঁধের কী প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল গোটা পার্বত্য অঞ্চলে? আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর সরকারি দলের নেতারা এখনও সেই একই কোরাস গেয়ে চলেছেন, ‘যদি ক্ষতিকর হয়’? যেখানে খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ওই অঞ্চল সফরে গিয়ে জোর গলায় বলছেন, যে কোনো মূল্যে টিপাইমুখ বাঁধ হবেই হবে, আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশা করে বসে আছেন, কোনো একটি গবেষণা-পর্যালোচনার ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর চিহ্নিত’ হলে এ বাঁধ হবে না?
মনমোহন তার দেশের ভালো চান, যা খুশি তার মতো করে করতে চান, আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখনও বসে আছেন ‘যদি’র নদীতে! এটি দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী?
ভারত আমাদের প্রতিবেশী।
ভারতের এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতায় তিস্তা চুক্তিটি করতে পারলো না বাংলাদেশ, মনমোহনের কথিত ঐতিহাসিক সফরটি ব্যর্থ হয়ে গেলো! আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ তার উপদেষ্টারা এখনও দেশের ন্যায্য পাওনাসহ নানা ইস্যুতে যে ভাষায় কথাবার্তা বলে চলেছেন, এসবের প্রতিক্রিয়া দেশ এবং তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা তারা আদৌ ঠাওর করতে পারছেন কী? কথাবার্তায় কিন্তু একদম মনে হচ্ছে না।
কিছুদিন আগে রাশেদ খান মেনন সংসদে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের বক্তব্য শুনে সন্দেহ হয়, তারা বাংলাদেশ না ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা! এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী পরিহাসচ্ছলে বলতে চান, অনেকে (মেননগং) ভুগছেন মন্ত্রিত্ব না পাবার মনোবেদনায়! শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুর সঙ্গে ঐকমত্যের কারণে এসব ধৃষ্ট অপমান সহ্য করে এখনও ১৪ দলীয় জোটে পড়ে আছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মেনন-ইনু গং! এসব এমন অবিরাম চলবে সে গ্যারান্টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কে দিয়েছে?
চারপাশের প্রতিক্রিয়া চোখকান খোলা রেখে বুঝে-শুনে না চললে কী করুন পরিণতি হতে পারে তা এখন বুঝছে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি। শনিবার এদেশের গুরুত্বপূর্ণ কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা নিদারুন হেরেছে! ৮৯ আসনের রাজ্যসভায় চলতি বিরোধীদল লিবারেল ন্যাশনাল পার্টি ৭৮ আসনে জিতেছে। আর ক্ষমতাসীনরা জিতেছে মাত্র ৭টি আসনে! এর আগের নির্বাচনে আনা ব্লেয়া দেশের ইতিহাসের প্রথম নারীর প্রিমিয়ার হিসেবে জয়ী হন। ২০১০ সালে কুইন্সল্যান্ডে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা আর এর পরপর সাইক্লোন ইয়াসিকা মোকাবেলায় দেশের মানুষ এই নারী প্রিমিয়ারের সাহসী লড়াই দেখেছে। সেই সাহসিকা আনা ব্লেয়ার এমন নিদারুন পরাজয় কেন? অস্ট্রেলিয়ার হালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খবর যারা রাখেন তারা জানেন, এর পিছনে দেশটির লেবার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের কার্বন ট্যাক্সসহ বিতর্কিত নানা কর্মসূচি দায়ী। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ মানুষ মনে করছেন, কার্বন ট্যাক্সসহ এসব বিতর্কিত বিষয়াদির কারণে তাদের জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু এসব সমালোচনা মানতে রাজি নন জুলিয়া গিলার্ড! তিনি এসবকে তার সংস্কার কর্মসূচি হিসেবেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন! অথচ তার এই কার্বন ট্যাক্স চালুর পর গুরুত্বপূর্ণ নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের পর কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের কর্তৃত্বও হারালো লেবার পার্টি। আর আনা ব্লেয়ার মতো নেত্রী পরাজয়ের দায় মেনে নিয়ে রাজনীতি থেকেও সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন বিএনপিসহ সবদলের অংশগ্রহণে হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন চরম অসুখী একটি জোটের কী পরিণতি হতে পারে, তা ঠাওর করতে পারছেন দেশের অনেক মানুষ! এখন প্রতিদিন একা একা নিজের গুণগান গেয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা! দলকানা ছাড়া তার গুণগান গাইবার লোকজনও যেন শুধু কমে আসছে!
টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুসহ ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সব ইস্যুতে দ্রুত ‘যদির সব হিসাব’ নদীতে ফেলে শক্ত ভূমিকা নিতে অনুরোধ করছি শেখ হাসিনাকে। এমনিতে কিন্তু দেশের বেশিরভাগ নদনদীর অবস্থা খুবই নাজুক। নদী-খাল ভরাট অথবা দখল হয়ে যাচ্ছে। চানক্য কূটনীতিবাজ ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাতো আছে, তার পাশাপাশি দেশের নানান অব্যবস্থা-লোভ এসবের কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইমেজ-ঐতিহ্য সবকিছুই এখন বিপদাপন্ন! আইসিইউতে যাবার অবস্থায়! শেখ হাসিনাকে বলি আপনার মার্কাতো আবার নৌকা। দেশের নদীনালাই যদি না থাকে, তাহলে এই নৌকা চলবে কী করে? আল্লাহর ওয়াস্তে সময় থাকতে ভারতের সঙ্গে পাওনার ব্যাপারে দরকষাকষিতে শক্ত ভূমিকা নিন। টিপাইমুখ শুধু না, উজানের আন্তর্জাতিক নদী যেটি যেখানে আছে, সেটিতে বাঁধ হলেই ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি জানতে-বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। সোজা হিসাবটি ভারতকে যদি বোঝাতে না পারেন, তাহলে জাতিসংঘে-আন্তর্জাতিক আদালতে যান। এসব নিয়ে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক আইন আছে। আন্তর্জাতিক আদালতে ঠিকমতো যেতে পারলে দেশের কী উপকার হয় তা সর্বশেষ মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রমাণ হয়েছে। ওই মামলার রায় দেখে এখন আবার ভারতীয়রা ভালোমানুষির মতো আলোচনার কথা বলছে। আল্লাহরওয়াস্তে সে ফাঁদে পা দেবেন না। টিপাইমুখ বাঁধ আটকাতেও এখনই আন্তর্জাতিক আদালতে যান। নতুবা আগামী নির্বাচনে নৌকা কিন্তু সবার আগে আটকে যাবে সিলেটে, সেখান থেকে সারাদেশে। নদীতে পানি না থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা কোনো ইস্যুতেই কিন্তু নৌকাকে আর পার করতে পারবেন না।
অতএব যদি’র হিসাব নদীতে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার তথা টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আদালতে বা ফোরামে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু এখনই সময়। সমুদ্রসীমার বিষয়টি যারা আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে গেছেন, তারা অগ্রিম এগিয়ে গেলে কিন্তু সরকারের আমছালা দুটিই যাবে।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ০৯০০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১২
সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর