কবি বলেছেন, ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’। কিন্তু আদতে স্বাধীনতা শব্দটি একান্ত আমাদের হয়েছে কী? জনে জনে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি এখনও আমাদের নানাজনের কাছে নানারকম। যার যার সুবিধামতো আমরা এর নিজস্ব সুবিধামতো সংজ্ঞা ঠিক করে নিয়েছি! পাকিস্তান-পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের বনিবনা টিকলোনা কেন? এর সোজা কারণ ছিল বৈষম্য, শোষণ। ভাষার সংঘাত দিয়ে এই বৈষম্য প্রথম চিহ্নিত হয়। যখন ভিন্ন একটি ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হয়, বিস্ফোরণ ঘটে। আমরা রুখে দাঁড়ালাম। এরপর পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য-শোষন যত স্পষ্ট হতে থাকল, যত স্পষ্ট হতে থাকল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় বৈষম্য, বিশ্বাসের ভিতটাও নড়বড়ে হয়ে গেল!
মুসলমানদের আলাদা দেশ হিসাবে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও এ অঞ্চলের সংখ্যাগুরু মুসলমানরা বরাবর ছিলেন উদার-ধর্ম নিরপেক্ষমনা। বাঙ্গালি সংস্কৃতি বরাবর এ অঞ্চলের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসবের নাম পহেলা বৈশাখ। নজরুল, গোলাম মোস্তফা সহ অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জীবনানন্দসহ আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক আমাদের আত্মার আত্মীয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসিকের নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ডা নীহার রঞ্জন গুপ্ত প্রমুখ। এসব বিষয়ও অপরাধ হিসাবে দেখা হয়! এসবকিছু ছাপিয়ে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের উন্নয়ন বৈষম্য, জিনিসপত্রের দাম, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রের বৈষম্যের প্রতিবাদে জনবিস্ফোরণ ঘটল উনসত্তুর, সত্তুর, একাত্তরে। এরপর সত্তুরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃ্ত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জনের পরও যখন সামরিকজান্তা আর পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃ্ত্ব ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইলোনা, তখন টুটে গেল রাষ্ট্রের বাঁধন। অসহযোগ আন্দোলন দমাতে নৃশংস ক্র্যাকডাউন, সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং সবশেষে বিজয়ী বাংলাদেশ।
১৯৯৩ সালে আমি প্রথম পাকিস্তান যাই। লাহোর-রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদ ঘুরতে ঘুরতে দুই দেশের উন্নয়ন বৈষম্য সরেজমিন টের পাই তখনই। এরমধ্যে রাজধানী নগর ইসলামাবাদতো এককথায় অনন্য। ছবির মতো সাজানো একশহর। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানেবেরা যারা দেখেছেন, তারা ঠাওর করতে পারেন ইসলামাবাদ-ক্যানবেরা শহর দুটি দেখতে একই রকমের। কারন দুটি শহরই একই আর্কিটেক্টের গড়া। ইসলামাবাদবাসী একজন বাঙ্গালি পাকিস্তানি সাংবাদিক শহরটির নানাকিছু সরেজমিন ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বলেন, এই ইসলামাবাদকে সাজাতেই পাকিস্তানিরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে ঠকিয়েছে! পাকিস্তানও আর টেকেনি। আমার কাছে অবশ্য এর অন্য একটি কারণও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধরে নিয়েছিল, ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির অবাক মানচিত্রের এই দেশ আদতে একসময় টিকবেনা। মাঝখানে বিশাল আরেক দেশ ভারত। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের বনেদি আর পূর্ব পাকিস্তানিদের হরিজন মুসলমান ভাবতো! মানসিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এত অসততা নিয়ে কী করে একটা দেশ টেকে? অতএব যা হবার হয়েছে। বাঙ্গালীরা বেছে নিয়েছে নিজস্ব স্বতন্দ্র মর্যাদার স্বাধীন একটি দেশ। বাংলাদেশ। আর হাজার অসততা নিয়ে এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র। এখন আন্তর্জাতিকভাবেও দেশটির কোন মর্যাদার অবস্থান নেই। এটি যারা আমরা বিদেশে আছি তারা প্রতিনিয়ত টের পাই। তখন আল্লাহ আর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
কিন্তু যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে স্বাধীনতা এসেছে, তা কী অর্জন হয়েছে? উত্তর না সূচক হয়ে থাকলে সাথে সাথে আরেকটি প্রশ্ন আসে, তাহলে কেন? যার জন্য যত অপ্রিয় হোক, এর সত্য জবাবটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নেতৃ্ত্ব এক্ষেত্রে নিদারুন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নেতৃ্ত্ব আবার পচাত্তরের পনের আগস্টের আগে-পরে দু’ভাগে বিভক্ত। পচাত্তরের পনের আগস্টের পর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের গতিপথও হারায়। ক্ষমতাদখলকারী জিয়া-এরশাদ রাজনৈতিকভাবে দেশকে আবার পাকিস্তানি ধাঁচে ফিরিয়ে নেন। সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমান একটি দেশ হবে বাংলাদেশ, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মসূচি সমাজতান্ত্রিক হবে, এসব বাহাত্তরের সংবিধানে স্বীকার করে নেওয়া হলেও পচাত্তরের পরবর্তী নেতৃ্ত্ব তা আমূল পালটে দেয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানি-বাংলাদেশি মিশেলে জগাখিচুড়ি কর্মসূচিতেই জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা জমানায় চলছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলেও সংবিধান সংশোধনের অবস্থা তাদের ছিলোনা। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃ্ত্বদাতা দলটি এবার সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা পেলেও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান স্টাইল তারা অটুট রেখেছে। বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে এরশাদ-খালেদা জিয়ার শাসনামলের অর্থনৈতিক অসততার বিষয়গুলোও এখনও পুরো মাত্রায় বহাল আছে।
একথা সত্য একাত্তরের অগ্রসর ছাত্র নেতৃ্ত্ব শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেও রাজনৈতিক নেতৃ্ত্ব ছিল পিছিয়ে। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল মনি, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখের নেতৃ্ত্বে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গ্রুপটি একাত্তরে ফেব্রুয়ারি থেকেই নানা প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ভারত থেকে কি সাহায্য পাওয়া যাবে... বা যাবে না তা জানতে এদের পক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্রনেতা লুৎফুল হাই সাচ্চু একাত্তরের ফেব্রুয়ারি থেকেই আগরতলা যাওয়া আসা শুরু করেন। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ এমএনএ, এমপিও যুদ্ধে জিতে না, নির্বাচনে জিতে সংসদে বসার বিষয়েই বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এদের সবার একচ্ছত্র নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু থেকে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নানা শাখায় নানান লোকজনকে আলোচনা-বিদ্রোহ উভয় প্রস্তুতিতে তিনি নিয়োজিত পরিচালিত করেছেন। এরজন্য আলোচনা চললেও স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ইস্তেহার প্রকাশ, জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজসহ কোন কিছুই থেমে থাকেনি। মার্চের শুরু থেকে সারাদেশের ঘরে ঘরে উড্ডীন হয় স্বাধীনতার পতাকা। এরপর ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পর সবপথ বিদ্রোহ আর স্বাধীনতামুখী হয়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গেলে ভারত প্রবাসী রাজনৈতিক নেতৃ্ত্ব আসে তাজউদ্দিনের হাতে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ভারতে যাবার পর থেকে সেখানে নানান সমীকরণও চলেছে। তাজউদ্দিন নেতৃ্ত্বের সঙ্গে ছাত্র-যুব নেতৃ্ত্বের বনিবনার সমস্যার কারনেও অনেক সমস্যা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন খন্দকার মোস্তাক নেতৃ্ত্বাধীন একটি গ্রুপের নানান সমস্যা তৈরি সত্ত্বেও একটি অদম্য অমিততেজি মুক্তিযোদ্ধাদলের অভাবিত সাফল্যের কারণে কোন সমস্যাই মাথাচাড়া দিয়ে জিততে পারেনি। পাকিস্তানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তিকে নাস্তানুবুদ পরাস্ত করে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে জিতে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। এরসঙ্গে অবশ্য বাংলাদেশের ভিতরে থাকা জনগোষ্ঠীর একচেটিয়া সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত জাতীয় কিছু কুলাঙ্গার ছাড়া স্বাধীনতার পক্ষে সাধারণ জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ ছিল। জনতা ভয়কে জয় করে সত্তুরের নির্বাচেনের মতো মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করে। সে কারণে ষোল ডিসেম্বর সারাদেশের বিজয়ী মানুষ যখন উৎসবে ব্যস্ত তখন পিঠের চামড়া বাঁচাতে পালাতে ব্যস্ত জামায়াতগং। স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর পরেও এদের অবস্থা সমান। প্রতিবছর ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের আগে এরা গর্তে লুকোয়। গর্ত থেকে বেরোয় উৎসব শেষে।
কিন্তু স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ শুরুতেই স্বপ্নভগ্নের বিপদে পড়ল কেন? নয় মাসের যুদ্ধে দেশ লন্ডভন্ড-বিধবস্ত ছিল সত্য। ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর বেদনা-কান্না। কিন্তু নতুন স্বাধীন দেশ বঙ্গবন্ধু ফেরার পর কেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলল জাতীয় ঐক্য? মুক্তিযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপ করে তখনকার কিছু বাস্তব ছবি পাওয়া যায়।
আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব শক্তির বাধার মুখেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় তারা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃ্ত্বের একাংশের সমন্বয়হীনতা-ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্বাধীন দেশেও থেমে থাকেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের উপযুক্ত মর্যাদা-মূল্যায়নের বিষয়টি প্রত্যাশা মাফিক হয়নি। যুদ্ধে যারা গেছেন তাদের সিংহভাগের গড় বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৫ এরমধ্যে। স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে ছাত্রনেতাদের গড় বয়সও ছিল ২৫ এর মধ্যে। যুদ্ধের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একাওরের বয়স ছিল ৫১ বছর। সরাসরি যুদ্ধে যারা গেছেন তাদের বেশিরভাগ ঘরপালানো ছেলে। গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত অথবা নিরক্ষর কৃষক, মুটে-মজুরের সন্তান। রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এদের সংখ্যাই নব্বুইভাগ অথবা এরচেয়ে বেশি। এরা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার টানে যুদ্ধে গেছেন। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন টার্গেট তাদের ছিলোনা। মনের মধ্যে হয়ত দেশ স্বাধীন হলে ভালো একটি জীবনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রণাঙ্গণে শহরবাসী শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের যে পার্থক্য চিহ্নিত হয়, তা স্বাধীন দেশ পর্যন্ত হেঁটে এসেছে। যেমন শহরবাসী শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে যুদ্ধে থাকতেই নিজেদের জন্য তুলনামূলক ভালো সুযোগ সুবিধা বেছে নিতে কৌশলী ছিলেন। দেশে ফেরার পরও তারা তা ষোল আনা বুঝে নিয়েছেন। আর যুদ্ধের সেই সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধার বেশিরভাগ স্বাধীন দেশে ফিরে চিহ্নিত হয়ে গেছেন বঞ্চিত-দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা! আজও দেশের সরকারগুলো এসব দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের করুণা দেখিয়ে চলেছে!
অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের বড় কোন চাহিদা ছিলনা। দেশ স্বাধীন হবার পর তারা অপেক্ষায় ছিলেন তাদের দেশগড়ার কাজে লাগানো হবে। কিন্তু তা হয়নি। তা না হবার কারণ হিসাবে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের ষড়যন্ত্র বলতেও ছাড়েনি। কিছু মুক্তিযোদ্ধার রক্ষীবাহিনীতে জায়গা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ নিক্ষিপ্ত হন হতাশার সমুদ্রে। অনেকে তখন বিপথগামীও হন। অনেকের মতে স্বাধীন দেশে এসে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন কোনঠাসা আর খন্দকার মোশতাকরা আপারহ্যান্ড পেয়ে যাওয়াতেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ঐক্য বিপন্ন হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী ও নকল মুক্তিযোদ্ধার হাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনা-ঠকানোর যে বাতিক শুরু হয়, সেখান থেকে আর বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারেনি। যুদ্ধে বিধবস্ত লণ্ডভণ্ড দেশের নাজুক পরিস্থিতির চাইতে আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ কিছু নেতার বেপরোয়া হওয়ার খবরও চাউর হয় বেশি। তখন যে দুর্নীতিবাজদের রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের চল্লিশ লক্ষ টন খাদ্যশস্য ধবংস হয়। এরমাঝে মার্কিন খাদ্য বোঝাই জাহাজ পথ থেকে ফিরিয়ে নেওয়াতে দেশ দূর্ভিক্ষের মুখে পড়ে। দূর্ভিক্ষে নিহতদের লাশের নিচে চাপা পড়ে যায় বাংলাদেশের স্বপ্ন। এরপর আবার সেই দূর্ভিক্ষ পরিস্থিতি থেকে দেশকে সফল টেনে আনার পরপর সপরিবারে অবিশ্বাস্যভাবে নৃশংসভাবে খুন হন বঙ্গবন্ধু। সেই খুনের সঙ্গে জড়িতরা স্বাধীনতা পরবর্তী নেতৃ্ত্বের দুর্নীতির কথা বেশি বেশি বলেছেন। কিন্তু তারা কেউ দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেননি বা ধরতে পারেননি। উর্দি গায়ে রেখেই উল্টো চিহ্নিত রাজনৈতিক দুর্নীতিবাজ এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে তারা রাজনৈতিক দল গড়েন। দেশকে ফেরত পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ধারায়! বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর নীতি আদর্শের বালাই নেই। ভারতের নেহেরু, পাকিস্তানের ভূট্টো ডাইনাস্টির মতো গণতন্ত্রের নামে মুজিব-জিয়া ডাইনাস্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের রাজনীতিতে। এসব ডাইনাস্টির প্রতি অনুগত থাকাই এখন দেশের রাজনীতির মূল নীতি-আদর্শ!
মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক স্বপ্নটি অধরা থেকে যাওয়ায় স্বাধীনতা শব্দটিও দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর একান্ত আপন আর না। আজকের তরুণ প্রজন্মও মুক্তিযুদ্ধ বা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রজন্মের মতো পোড় খাওয়া না। এদের অনেককে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস শেখানো হয়েছে। বর্তমানের বাস্তব অর্থনৈতিক সংগ্রামে পর্যুদস্ত প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বা কোন নীতি আদর্শই টানেনা। এদের সিংহভাগ রাজনীতিবিমুখও। রাজনীতিকে ধান্ধাবাজদের বিষয় হিসাবে দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধীরা এখানে নিজেদের মতো করে আলাদা একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সে কারনে তারাও চাকরি ও নানা অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে এমন যুবকদের অনেককে তাদের পক্ষে টেনে নিতে পারছে। টাকারগুণে এরা এখন দলবদ্ধভাবে প্রচারও করে, একাত্তরে জামায়াতের বাংলাদেশ-বিরোধিতা, পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়াটা দোষের ছিলনা! একাত্তরে জামায়াত সহ যে স্বাধীনতা বিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী নাম দিয়ে খুন করতো তারাও এখন টাকার বিনিময়ে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দল গড়ে! অন্যতম সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানকেও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সম্বর্ধনা দেয়। টাকার বিনিময় কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রবের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের টিভি চ্যানেলের শোভাবর্ধনে নিয়ে যেতে পারে! রাজনৈতিক সুবিধাবাদী অথবা নীতিহীনতায় স্বাধীনতার ঘোষক দাবিদার দল আত্মস্বীকৃত স্বাধীনতা বিরোধী, একাত্তরের নৃশংস খুনিদের দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি বাড়াতে চায়। ক্ষমতায় গেলে তাদের মন্ত্রিত্বও দেয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাদের বিচারের বিরোধীতা করে। আজ জনমতের চাপে যারা তাদের বিচার করছে, সেই আওয়ামী লীগও ১৯৯৪-৯৬’তে কৌশলগত ঐক্যের নামে তাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে ক্ষমতায় গেছে। মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শের সবকিছুর সঙ্গেই এমন সুবিধাবাদ মিশে গেছে!
এমন সবকিছু সত্ত্বেও স্বাধীনতার একচল্লিশ বছরে বাংলাদেশ যে অনেক এগিয়েছে তাও সত্য। বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন প্রায় এককোটি বাংলাদেশি। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখন দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষী বাহিনী, গার্মেন্টস সেক্টরে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব শক্তি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি। আমাদের ড ইউনুস শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। রবীন্দ্রনাথের মতো অমর্ত্য সেনও আমাদের। বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেখা গেছে, দেশের মানুষ কী রকম ঐক্যবদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়তে জানে। সবশেষ একটা ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে সবাই দেখেছেন দেশ কী রকম ঐক্যবদ্ধ হয়! মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে দেশকে উজ্জীবিত করে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগিয়ে নিতে দরকার জনগণের কাছে জনগণের চোখে সৎ নেতৃ্ত্ব। শুধু আমি সৎ আমি সৎ বলে কোরাস গাইলে হবেনা। মানুষ বেছে নেবে কে সৎ কে অসৎ। মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো মন্ত্রী বেশি বেশি দরকার। এসব প্রতিষ্ঠা, নিশ্চিত করা গেলেই দেশের অর্থনীতি অনেক দ্রুত পাল্টাবে। অর্থনৈতিক অবস্থা পাল্টালে আমাদের আর বেশি মনে হবে স্বাধীনতা শব্দটা একান্ত আমাদের। যা আমরা বিদেশে বসে নিরাপদ ভাবতে পারি। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এত মানুষের বিদেশে প্রতিষ্ঠা হতোনা।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৪১০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ