ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কবিতা

সাহসী সত্তর/ পর্ব-৪

মতিন বৈরাগী: বৈপরীত্যেও অনিবার্য বিপ্লব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৬
 মতিন বৈরাগী: বৈপরীত্যেও অনিবার্য বিপ্লব

মতিন বৈরাগী: বৈপরীত্যেও অনিবার্য বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম

পারস্পরিক পারম্পর্য ভেঙে যায়, তৈরি হয় নতুন দ্যোতনা, পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি এভাবেই আমাদের ভাবনাকে ছিন্ন-বিছিন্ন করে দিয়ে চেতনায় বুনে দেয় নতুন ভাবনার বীজ। সত্তুরের অন্য কবিদের থেকে এখানেই মতিন বৈরাগীর স্বাতন্ত্র।

তিনি যখন বলেন, ‘মিহিন জলের শরীর, স্তব্ধ বৃক্ষরাজি, পাখিরা নিশ্চুপ’ আমরা এক মৌন প্রকৃতির গভীরে অবগাহন করি। কেউ কেউ নস্টালজিক হয়ে পড়ি, ফিরে যাই দূরের শৈশবে, নিস্তরঙ্গ পুকুর পাড়ে, কোন এক নির্জন আমতলায়। কিন্তু এই নির্জনতা মুহূর্তেই ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় যখন পরের পঙ্‌ক্তিতে তিনি বলেন, ‘একটা বেজি দৌড়ে গেলো একটা আকাশ এলোমেলো’। এখানেও কিন্তু স্থির থাকেন নি কবি, এরপর বলেন, ‘উদ্ভ্রান্ত দিনের শেষের আলোটুকু চুইয়ে পড়লো জলে/ কারো গলার আওয়াজ থমকে থাকল পাতার সবুজে’। এভাবে তিনি নির্মাণ করেন ভিন্ন ভিন্ন ইমেজ, এলোমেলো করে দেন পাঠকের ভাবনাকে।
‘অসহায় মুহূর্ত’ কবিতায় আমরা তাকে পাই এভাবে:

‘সারাদিন মিস কল সারাদিন একলা আকাশ
ঝরে যায় সবটুকু রঙ ভাসে কান্নার ধ্বনি
সারাদিন কে এক তুমি বসে থাক পাশে
তারকারা ওড়ে জোনাকির পাখায় ক্লান্তিকে ছোঁয়
তবু দেয়াল ভাঙ্গার গান কে গায়, কে বাঁধে!’

প্রতিটি পঙ্‌ক্তি তৈরি করে স্বতন্ত্র ইমেজ, পঙ্‌ক্তিগুলোর মধ্যে এই পারম্পর্যহীনতা কবিতার ব্যাপ্তিকে ছড়িয়ে দেয় এক বিশাল ক্যানভাসে এবং শেষ পর্যন্ত ছোট ছোট অসংখ্য ইমেজ মিলে তৈরি করে এক সুবৃহৎ ইমেজ, যা হয়ে ওঠে এক সার্থক কবিতা। কোন না কোন ভাবে মতিন বৈরাগীর কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে গণমানুষের মুক্তির গান। আগুন-জলের পারস্পরিক বৈপরীত্যও তার কবিতায় সমার্থক, গণমানুষের মুক্তির হুঙ্কার, অনিবার্য উপমা। এমন কি অন্ধকারও হয়ে ওঠে বিপ্লবের  হাতিয়ার। ‘তুমি অগ্নিদেব ত্রিলোকের – যমের আগুন/ খেয়ে নাও এই লাশ আজ, সকলে খেয়েছে ঢের/যখন সে বেঁচেছিল’। (সেই থেকে আগুন হয়েছে সর্বভুক)। ‘তারপর যদি আগুনের লেলিহান ভেদ করে জানালার কাচ এবং/ এক হিংস্র আলোক ছিটকে পড়ে/ তখন ঘরের ইতর প্রাণীরা কাঁপে, চুপটি করে লুকায় এখানে-সেখানে-/ তখন আরও বেশী অন্ধকার চাই, অন্ধকার আমাদের খুব প্রয়োজন’। (নানা রকম গল্প-১) ‘হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত খুব, একটু বিশ্রাম একটু জল/ ঠিক কখন যে আমি নদীটার কাছে পৌছলাম!/ দেখি শীতের রাত কেউ যেন বসে আছে/ জিজ্ঞেস করতেই সে বললো: আমি নদী, জল নেই তাই বসে আছি-/ জল এলে তবে স্রোতধারাগতি/ হঠাৎ পাতাগুলো ফরফর করে উঠলো দূরে বেদনার জোছনায় বালুগুলো/ উড়ছে, পায়ে হেঁটে সেই নদী পারাপার/ স্থবির একটু জল তার শিরায়/ আমি মুখে তুলতেই সে বললো: -এইটুকু-/ ঝাউগাছগুলো মরে গেছে আর ছড়িয়ে আছে পাখির পালক/ থমকে আছে সময় নদীটার মাঝে/ যে রকম আমরা থমকে গেছি এক অদৃশ্য ইচ্ছের কাছে’। (অদৃশ্য ইচ্ছের কাছে)

ফ্রেদেরিক লোরকা এবং পাবলো নেরুদাকে যৌবনে খেয়েছেন কবি, এ তার কবিতার শরীর ছুঁলেই বোঝা যায়। আঙ্গিক নির্মাণের ক্ষেত্রেও কবি মতিন বৈরাগী বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। কখনো অক্ষরবৃত্ত, কখনো মাত্রাবৃত্ত আবার কখনো দেখি টানা গদ্যে লিখে চলেছেন তিনি। আঙ্গিক যা-ই হোক না কেন বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাকে খুব কমই আপোষ করতে দেখি, বিপ্লব, বিপ্লব এবং বিপ্লব। এই শব্দটি মন্ত্রের মতো প্রোথিত মতিন বৈরাগীর কবিতায়।

‘জগৎটা দাঁড়িয়ে আছে না-কি শেষ হয়ে গেছে? এখন তুমি লাশ, পড়ে আছ সড়কে। হাওয়া উড়ছে, ধুলো, বুটের শব্দ-তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো উদোম সড়কে! মাত্র কয়েক মুহূর্ত, হৈ চৈ ভাঙচুর, চিৎকার স্লোগান, মানিনার তারস্বর, তারপর এক মৃত পাখি। তির তির করে কাঁপছিল চোখের তারা। কী চাইছিলে, কেউ তোমাকে তুলুক? নামধাম-হাসপাতাল-কেউ আসেনি। তুমি পড়ে আছো মুখ গুঁজে ইঁদুরের মতো-হিম অন্ধকারে। মুছে গেছে চোখের আলো-কার প্রয়োজনে?’

আবার যখন তিনি পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে সরব হয়ে ওঠেন তখনো দেখি গাইছেন সেই একই বিপ্লবের গান:

দিন ছিল না জীবন ভর রাতটা ছিল কাছে
রোদ ছিল না শরীর জুড়ে দুখের ছোঁয়া আছে
মলিন ছিল স্বপ্নগুলো আশা আলোকহীন
ভাবনাগুলো ছেঁড়া শরীর হয়েছে আজ ক্ষীণ
উড়ছিল না পাখিরা সব ছবির মতো চোখে
অন্ধকারে প্রকাশগুলো জীবনগতি রোখে
যাত্রাদিনে পথ ছিল না আশার আলো সম
ক্লান্তিরা যে লেগেই ছিল হৃদয় জুড়ে মম
(দিন ছিল না)

এই কবিতায় আমরা যে হতাশা দেখতে পাই এটাই বিপ্লবের আঁতুড়ঘর।

বৈপ্লবিক চেতনার এক সুদীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে এসে, অতি সম্প্রতি, ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর ‘আমারই অন্য নাম?’ প্রশ্নের বিভায় তিনি খোঁজেন এক অমোঘ উত্তর, নিজেরই কাছে।

‘তুমি, হাজার নামের দারুণ শক্তিমান কোথায় না তুমি আছ?
জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে ধ্যানে-জ্ঞানে প্রেম-প্রতারণায় হত্যায় ধ্বংসযজ্ঞে
ধর্ষণে-মঙ্গলে হর্ষহুল্লোড়ে বিষাদে নির্জনে
মহাকাশ নক্ষত্রপুঞ্জে বিশব্রহ্মান্ডে চেতনায় স্বপ্ন-জাগরণে
ধর্মে-অধর্মে জেহাদে লুট-চুরি-পাচারে
তুমিও কি নেশার ধোঁয়ায় উড়ছ!
ওহে অনড় বিশ্বাসের মায়াবৃক্ষ আমি বুঝিনা-বলো:
তুমি যদি নিয়মের নাম তাহলে অনিয়ম কেন?

হে তুমি দেখাও তোমার ‘তুমিত্ব’ একবার
যা নিয়ে বিশেষ হয়েছ। তুমি কি আমি?
আমারই অন্য কোন নাম! জলতলে গড়িয়ে যাওয়া অলিক পাথর?
(আমারই অন্য নাম?)

এ এক জটিল প্রশ্ন বটে। দেয়াল ঘড়ির দোলকের মতো দুলে ওঠে কবির বিশ্বাসের ভিত। এই কবিতায় আমরা কবিকে কিছুটা সংশয়বাদীর ভূমিকায় দেখতে পাই। এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে কবি সকল অনিয়ম, অসাম্যের সমাধান প্রত্যাশা করেছেন কোন এক ‘তুমি’র কাছে। কবি মতিন বৈরাগীর চৈতন্যের এক ইউ টার্ন আমরা দেখি এই কবিতায়। আধ্যাত্মিকতার এক নিবিড় ঘোর আমরা দেখতে পাই এই পঙ্‌ক্তিগুচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করবো কবি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে স্থির হন তা দেখার জন্য। সেই সাথে প্রত্যাশা রাখছি দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোয় স্নাত নতুন কিছু কবিতা যা বাংলা কবিতার অঙ্গনকে করবে আলোকিত, সমৃদ্ধ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৬
এমজেএফ/

শিহাব সরকার: বনগহনের নিবিড় হাতছানি
সানাউল হক খান: একজন স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী
আবিদ আজাদ: বহুমাত্রিক কবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ