ঢাকা, বুধবার, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে স্থবির মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ

নাদিম হোসাইন, মুন্সিগঞ্জ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২২
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে স্থবির মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ

মুন্সিগঞ্জ: বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে স্থবির হয়ে পড়েছে মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ। কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বছর আগে।

এরমধ্যে কোনো উপজেলায় বছরে দুইবার কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। আবার কোনো উপজেলায় দুই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে ব্যর্থ জেলা ছাত্রলীগ। এসব নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল ও তাদের ছবিতে জুতাপেটা, অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া স্বেচ্ছায় কয়েকজন মূলপদ থেকে পদত্যাগ করেন।

২০১৫ সালে মো. ফয়সাল মৃধাকে সভাপতি ও ফয়েজ আহম্মেদ পাভেলকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন দেয় তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকি নাজমুল আলম। পরে ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর ১০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয় তৎকালীন সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম জাকির হোসাইন।

এদিকে, এ অনুমোদিত ১০১ সদস্যের কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় ৪০ নেতা বিয়ে করেছেন। এছাড়া প্রায় ২০ জন প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। বাকি কয়েকজন চাকরিজীবী। আর এতেই স্থবির হয়ে পড়েছে জেলা ছাত্রলীগ।

এদিকে দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে জেলা, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড এবং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন জেলা কমিটির সম্মেলন না হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ। পদবঞ্চিত হয়েছে তরুণ ও মেধাবীরা।  তাছাড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল মৃধার বিরুদ্ধে চুরি, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অভিযোগ এবং থানায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। চুরি মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন। ফয়েজ আহম্মেদ পাভেলে বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

অন্যদিকে, সদর উপজেলা ছাত্রলীগ, সরকারী হরগঙ্গা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ, পৌর ছাত্রলীগ, পলিটেকনিক্যাল ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৭ বছর আগে। এসব কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদকসহ সবাই বিবাহিত। তাদের মধ্যে কয়েকজন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এবং রাজকীয়ভাবে বিয়ে করেছেন।

গজারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল চেয়ে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধসহ বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ছবিতে জুতাপেটাসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই সময় নেতাকর্মীরা স্লোগান দেন টাকার বিনিময়ে রাতের আঁধারে দেওয়া কমিটি বাতিল করতে হবে। পরে উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ফয়সাল মৃধা ও সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাভেলকে গজারিয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।  

এছাড়া জেলার শ্রীনগরে উপজেলা ছাত্রলীগের একাংশ সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে। তারা দাবি করেন, টাকার বিনিময় কমিটি গঠন করা হয়। তাদের অভিযোগ, কোনো রকমের সম্মেলন ছাড়াই গত ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক শ্রীনগর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করে। গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে গঠিত সে কমিটিতে যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হয়নি।

অপরদিকে, জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন চেয়ে আড়াই বছর ধরে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয়নি জেলা কমিটি। এ কমিটির অনুমোদন দেওয়ার জন্য উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দীপু মাঝি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাভেলকে অনুরোধ জানালে মোবাইল ফোন কথোপকথনে জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক তাকে জানান, আমি পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেব না। ফোনালাপের এ অডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে ভাইরাল হয়। এছাড়া, লৌহজং উপজেলা মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩ বছর আগে। টঙ্গীবাড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হলেও তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে ২ বছর আগে।

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল মৃধা ও সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ পাভেল, সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সুরুজ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান লাকুম, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নছিবুল ইসলাম নোবেল, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিবির আহম্মেদ ও সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রায়হান রাফি, মিরকাদিম পলিটেকনিক্যাল ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল হাসান তারিফ, সাধারণ সম্পাদক আসিক, টঙ্গীবাড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দীপু মাঝি, লৌহজং উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরহাদ হেসেন  বিয়ে করেছেন কয়েক বছর আগেই। তাছাড়া ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক শিহাব আহম্মেদ পদত্যাগ করেন।

এসব বিবাহিত নেতাদের হাতে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃর্ণমূল নেতাকর্মীরা। কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। কমিটির বয়স যদি ৭-৮ বছর হয়ে যায় তাহলে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স থাকে না ছাত্রলীগ করার। এতে সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তারা বলছেন ছাত্রলীগের রাজনীতি গতিশীল করতে দ্রুত সম্মেলন প্রয়োজন এবং অছাত্র, বিবাহিত, প্রবাসী, চাকরিজীবী বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব অতি প্রয়োজন। তা না হলে ছাত্র রাজনীতি থেকে অনেক মেধাবী ঝরে যাবে।

শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসাইন সাগর বাংলানিউজকে বলেন,  ৮ বছর ধরে জেলা ছাত্রলীগের কোনো সম্মেলন নেই। ছেলেরা র্দীঘদিন ধরে দলের পেছনে শ্রম দিচ্ছে কিন্তু কমিটি পাচ্ছে না। মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ আর ছাত্রলীগ নেই। এখন ছাত্রলীগটা হয়ে গেছে ব্যবসায়ী ছাত্রলীগ। মুন্সিগঞ্জে ছাত্রলীগের সম্মেলন দরকার। র্দীঘ ৭ থেকে ৮ বছর ধরে জেলা ছাত্রলীগের ব্যানারে কোনো শব্দ বলতে দেখিনি।  

টঙ্গীবাড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি খালিদ হাসান খান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কমিটি ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে আমরা ৮টি ইউনিয়ন কমিটি অনুমোদন দিয়েছি। গত দুই বছর আগে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করি। পরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে জমা দেই। এখন পর্যন্ত আমাদের কমিটির অনুমোদন দেয়নি। বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা শুরু করেছে। এক পর্যায়ে সাধারণ সম্পাদক দীপু মাঝি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাভেলকে ফোনে অনুরোধ জানালে কথোপকথনে জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক তাকে জানায়, কোনোক্রমেই আমি পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেব না। ফোনালাপের অডিওটি মুহূর্তে ফেসবুকে ছড়িয়ে ভাইরাল হয়।  

তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে রাতের আঁধারে আমাদের কমিটি ভেঙে ফেলবে। তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগ একটি নিয়মন্ত্রান্তিক ও গঠনন্ত্রান্তিক সংগঠন। এক বছর মেয়াদে জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের অনুমোদন দেওয়া হয়। পর্যাক্রমে এটা দুই বছর চলে কিন্তু আজ ৭ বছর ৬ মাস চলছে। এছাড়া বেশির ভাগ জেলা উপজেলার নেতারা বিয়ে করে ফেলেছেন। দীর্ঘদিন জেলা কমিটির সম্মেলন না হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পরছে ছাত্রলীগ। পদবঞ্চিত হয়েছে তরুণ ও মেধাবীরা। অতি দ্রুত সম্মেলন দিয়ে কমিটি গঠন করা হোক।

জেলা ছাত্রলীগের আরও এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের জেলায় ছাত্রলীগের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। শুধু দলাদলি। ছাত্রলীগ সংগঠনটি আটকে আছে শহরের দুই নেতার আদলে। মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস ও মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের বড় ছেলে ফয়সাল বিপ্লবের কাছেই ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটি আটকে আছে। তারা চাইলে কে সভাপতি বা কে সাধারণ সম্পাদক দিতে পারে। এ জায়গায় মেধার কোনো মূল্য নেই। যার টাকা আছে বা কে কার অনুসারী তাহলেই হবে। শুধু দেখে যাচ্ছি ছাত্রলীগ কিভাবে ধ্বংস হচ্ছে।

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাভেল বাংলানিউজকে বলেন, মেয়াদ শেষ হলেই কমিটি দেওয়া হয়। যে ভাগ না পায় তাহলেই শত্রু হতে হয়। গ্রুপিংয়ে গ্রুপিংয়ে সমস্যা হয়। এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নতুনভাবে কমিটি হয়েছে। তারা যেভাবে দিক নির্দেশনা দিবে আমরা সেভাবে কাজ করবো। টঙ্গীবাড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটির অনুমোদন প্রসঙ্গে বলেন, তারা যে কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল তাতে দেখা গেছে ছাত্রদল, শিবিরসহ অন্যান্য কর্মী থাকায় তাদের কমিটি পুনরায় আবেদন করতে বলা হয়েছিল। পরে আর তারা কমিটির জন্য আবেদন করেনি।

জেলা ছাত্রলীগরে সভাপতি ফয়সাল মৃধা বাংলানিউজকে বলেন, আপনারা এ ধরনের অভিযোগ কোথায় পান। একজনে বললো আপনি আমলে নিলেন, তাহলে যাচাই করেন বলে রাগারাগি করে ফোনটি কেটে দেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২২
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।