ঢাকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পূর্ণ করে ৭৫ বছরে পা দিলো। বাঙালির অধিকার ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের নাম।
শুক্রবার (২৩ জুন) আওয়ামী লীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণকারী আওয়ামী লীগ নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই ও সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দীর্ঘ ৭৪ বছরের পথ পরিক্রমায় এই দলটিকে ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন দিক থেকে সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবার অন্ধকার পথ পারি দিয়ে আলোর দিগন্তে পৌঁছেছে। জন্মলগ্ন থেকেই দলটিকে সংকট সম্ভাবনাকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরোনো ঢাকার কে এন দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম নিয়ে এ দলটি প্রতিষ্ঠা হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন এ দল গঠন করেন।
সাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ পূর্ব পাকিস্তানে (পূর্ব বাংলা) শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার প্রসার ঘটতে থাকে। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা এ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় ছয় বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নামে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামের ব্রত নিয়ে এ রাজনৈতিক দলের আত্ম প্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। প্রথম সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পান এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রসর হতে থাকে। এই অসাম্প্রদায়িক নীতিই হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বের দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলে রূপান্তরিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসন-নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন এক পর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে যায়। ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, এর পর ১১ দফার ভিত্তিতে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতার সংগ্রাম, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি শাসন আমলে এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী দীর্ঘ সময় দেশে একের পর এক আসা সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি।
এ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কখনো নেতৃত্বের শূন্যতা, কখনো দমন-পীড়ন নির্যাতনের শিকার, কখনো ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে এ দলটিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। নেতৃত্বের এই শূন্যতা থেকেই দলের মধ্যে একাধিক ভাঙন ও গ্রুপিং ও বহু ধারায় বিভক্তি দেখা দেয়। দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। নির্বাসনে থাকা অবস্থায়ই শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করা হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। গত ৪ দশকের বেশি তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এ সময়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চার বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। তবে ৭৩ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে, আন্দোলন-সংগ্রামে। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করলেও তা বেশি দিন টেকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর এবং বর্তমানে টানা সাড়ে ১৪ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত অবস্থানে অনড় থাকার সংগ্রামও চালিয়ে যেতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ ৭৪ বছরের ইতিহাসে সব চেয়ে বেশি সময় সভাপতির দায়িত্বে থেকে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০২৩
এসকে/আরআইএস