রাজশাহী: দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুরুতর আহত রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে এতদিন থেকে চলা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে প্রকাশ্যে।
আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের জানাজায় গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের বর্তমান সদস্য শাহরিয়ার আলম আজ সরাসরি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে এই ঘটনায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ তুলেছেন।
এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল নিহতের ঘটনায় পেছন থেকে মদদদাতা হিসেবে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন ও বাঘা উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাবলুর নামে মামলা করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন- শাহরিয়ার আলম এবং এর সুরহা না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দেন তিনি।
এছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের জানাজায় গিয়ে তোপের মুখে পড়েন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অনীল কুমার সরকার।
এদিকে জানাজার মাঠে প্রকাশ্যে এমন হুমকি এবং কটূক্তির ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বিকেলে নিজ দপ্তরে জরুরি ব্রিফিং করেন।
সেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি জানান, নিহত আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের জানাজার মাঠে তাকে জড়িয়ে স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলমের দেওয়া বক্তব্যটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। খায়রুজ্জামান লিটন এ সময় বাঘা-চারঘাট আসনের সংসদ সদস্যের এমন বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বেলা ১১টায় রাজশাহীর বাঘা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাজার নামাজ পড়ান বাঘা ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মওলানা আব্দুল গফুর মিঞা। আর রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের জানাজায় গিয়ে প্রথমেই তোপের মুখে পড়েন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার সরকার।
বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একাংশ তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন এবং সেখানে সভাপতির সাথে ধাক্কাধাক্কিও হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি সেখান থেকে চলে যান।
এরপর জানাজার মাঠে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল হত্যার ঘটনায় যারা পেছন থেকে মদদ দিয়েছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। হত্যাকারীদের মদদদাতা প্রত্যেকেই বিচারের আওতায় আনা হবে।
এমপি শাহরিয়ার আলম বলেন, আজ রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ, সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলু কেন এই জানাজায় আসেননি। তাদের সৎ সাহস নেই। তাই তারা এই জানাজায় উপস্থিত হননি। তবে পেছন থেকে তারা- যারা মদদ দিয়েছেন তার মধ্যে আসাদুজ্জামান, আসাদ, খায়রুজ্জ্বামান লিটন এবং বাঘা উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দুন লাবলুর নামে নামে আমরা মামলা করবো। বাঘা শান্তিপূর্ণ জায়গা; পুণ্যভূমি সেখানে কেন এত শান্তির সৃষ্টি হলো, আর কারাই বা করলো?
এ সময় এই ঘটনার শেষ দেখতে মাঠে থাকারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন শাহরিয়ার আলম।
এদিকে বাঘা-চারঘাট আসনের এমপি শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা উল্লেখ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বিকেল ৪টায় নগর ভবনে মেয়রদপ্তর কক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে করা এক ব্রিফিংয়ে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘গত কিছুদিন আগে বাঘায় দুইপক্ষের সংঘর্ষে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল গুরুতর আহত হয়। তাকে চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এবং চিকিৎসা নিয়ে তার অবস্থার উন্নতি হয়। হঠাৎ করে গতকাল বুধবার (২৬ জুন) সকালে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। বিকেলে ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে তিনি মারা যান। মরহুম বাবুল সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা এবং আমার অনেক স্নেহভাজন ছিল। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তাকে পাশে পেয়েছি, বাবুল যখন ছাত্রনেতা, তখন থেকেই। তিনি নিবেদিত প্রাণ আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করার মতো নিন্দনীয়, নৃশংস ঘটনার সঙ্গে আমার কোনোভাবে জড়িত থাকার কারণ নেই, কোন সুযোগ নেই, যুক্তিও নেই। আজ মরহুমের জানাজায় আমাকে দায়ী করে, সরাসরি আমার নাম ধরে, আমার দলীয় পদ উল্লেখ করে, আমার পাশাপাশি আমাদের আরেকজন সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদসহ আরো কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বাঘা-চারঘাটের বর্তমান এমপি কীভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঈর্ষাপরায়ণভাবে এমন উক্তি করতে পারেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। জানাজা নামাজ একটি পবিত্র কাজ, যেখানে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা হয়, সেখানে এভাবে মামলা করা হবে, মোবাইল কললিস্ট চেক করা হোক, মামলার আসামি করা হবে-এই সমস্ত কথা তার কাছ থেকে আমি আশাই করিনি। তিনি কী উদ্দেশ্যে বলেছেন, কেন বলেছেন তা তিনিই বলতে পারবেন। যারা রাজনীতি সচেতন ও বিবেকসম্পন্ন মানুষ তারা নিশ্চয়ই এ রকম কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করবেন না। করার কোন কারণ নেই। ’
আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আমরা একজন দলীয় নেতাকে হারালাম। এ ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও কষ্টকর। বাবুল হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আমিও চাই। আমার বয়স এখন ষাটের ওপরে। আমার রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের ঘটনায় মদদ দেওয়ার ইতিহাস নেই। মনে হচ্ছে যেন লাশটি কারও দরকার ছিল। একজনের মৃতদেহ দরকার ছিল যেটাকে পুঁজি করে রাজনীতি করা যায় এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এ রকম একটা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারী একটি গোষ্ঠী ছিল, এখনো আছে বলে আমি মনে করি, অনেকেও তাই মনে করেন। এই লাইনেও বিষয়গুলো তদন্ত হওয়া দরকার। ’
খায়রুজ্জামান লিটন আর বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনের পর রাজশাহীতে যারা নতুন সংসদ সদস্য হলেন, তারা নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে গিয়ে ভাল-মন্দ অনেক কিছু করেছেন। আমরা যারা বংশগতভাবে, জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ করি, ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, মেনেছি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে মেনে রাজনীতি করি, আমরা হচ্ছি আদি ও অকৃত্রিম। যারা পরে নানাভাবে এসেছেন, তারা কী উদ্দেশ্যে এসেছেন, জনগণ ভালোভাবে বলতে পারবেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও যারা তাদের চেনেন জানেন, এলাকাবাসী তারা ভালো বলতে পারবেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমরা যারা আওয়ামী লীগের রক্ত নিয়ে বড় হয়েছি, তাদেরকেই এখন হেনস্তা করার অপচেষ্টা করছেন এই নতুনরা। ’
রাসিক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, বাবুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে বুধবার আমি হাসপাতালের মর্গে গিয়েছিলাম। তার সন্তানের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছি। আমি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে থাকবো ইনশাল্লাহ।
এদিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়া লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের জানাজার নামাজ বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) সকাল ১১টায় বাঘা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। পরে তার মরদেহ দাফন করা হয়। এর আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (২৬ জুন) বিকেলে তার মৃত্যু হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার সময় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
দুই গ্রুপের নেতাকর্মীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের বয়স হয়েছিল ৫০ বছর।
আজ জানাজার মাঠে আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের বড় ছেলে আশিক জাবেদ- বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাছ আলীসহ তার বাবার হত্যাকারী সব আসামিদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচারের আওতার আনার দাবি জানান।
এছাড়া জানাজার আগে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের স্ত্রী বেবি বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী কেমন মানুষ ছিলেন তা আপনারা সবাই জানেন। এই হত্যাকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিচার দাবি জানাই। ’
এর আগে গত ২২ জুন রাজশাহীর বাঘা উপজেলা সদরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের নেতাকর্মী। এতে উভয়পক্ষের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। তাদের মধ্যে বাবুলের অবস্থা ছিল আশংকাজনক। জমির দলিল রেজিস্ট্রির সময় দিনের পর দিন বাড়তি টাকা আদায় করে আসছে বাঘা উপজেলা দলিল লেখক সমিতি। উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ সমর্থন দিয়ে থাকে এই সমিতিকে। আর অন্য একটি অংশ অবস্থান নেয় দলিল লেখক সমিতির এই দৌরাত্ম্যের বিপক্ষে। দলিল লেখক সমিতিকে সমর্থন দেওয়া বা না দেওয়ার দ্বন্দ্বেই গত শনিবার (২২ জুন) সংঘর্ষে জড়ায় দুপক্ষ।
রাজশাহীর বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সংঘর্ষের দিন আশরাফুল ইসলাম বাবুলকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়েছিল। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বুধবার বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। নিহতের মরদেহের ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া মারামারির ঘটনায় যে মামলাটি হয়েছিল, সেই মামলাটিই এখন হত্যা মামলায় রূপ নিয়েছে। তারা মামলাটি অধিকতর গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করছেন। অগ্রগতি হলে পরে তা জানানো হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৪
এসএস/এসএএইচ