ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

রাজশাহীতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২২
রাজশাহীতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি

রাজশাহী: রাজশাহী অঞ্চল এক সময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবখানেই বিএনপি সমর্থিত বা মনোনীত প্রার্থীদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য ও দাপট।

বছরের পর বছর ধরে বিএনপির এই দুর্গ দখল করতে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে রাজশাহীতে বড় ধাক্কা খায় বিএনপি। ওই সময় থেকে এ অঞ্চলে কঠিন সময় পার করছে দলটি। রাজনৈতিকভাবে একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে এক সময়ের দাপুটে এই দলটি।

এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে একের পর এক মামলা, গ্রেফতার আর দলীয় কোন্দলে এখন রাজশাহীতে অনেকটায় নিস্তেজ বিএনপি। কর্মসূচি দিলেও থাকে না আগের সেই জৌলুস। ফলে গত ১৪ বছরে স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচন কোনোটিতেই আর তেমন সফলতার মুখ দেখেনি দলটি। ভঙ্গুর হয়ে পড়ে নেতাকর্মীদের মনোবল। তার প্রভাব গিয়ে পড়ে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী দলটির গণসমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য এসেছে। রাজশাহীতেও নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। গণসমাবেশের এই আয়োজন রাজশাহীতে বিএনপির নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। ঢাকা ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে সর্বশেষ সমাবেশ করবে বিএনপি। তাই ঢাকার সমাবেশের আগে রাজশাহীতে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চায় দলটি।

সমাবেশকে সফল করতে এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিরামহীন প্রচারণা চালাচ্ছেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা। ব্যাপক লোকসমাগমের টার্গেটে মাঠে নেমেছে দলটি। প্রতিদিনই নেতাকর্মীরা গণসংযোগ, প্রচার মিছিল, লিফলেট বিতরণসহ নানা কাজে অংশ নিচ্ছেন। গণসমাবেশে উপস্থিতি বাড়াতে গোটা বিভাগজুড়েই নেতাকর্মীরা প্রচারকাজে একযোগে নেমেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা গণসমাবেশের সার্বিক প্রস্তুতি তদারকি করছেন।

রাজশাহীর বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলে রাজনীতির মাঠে বিএনপি নিজেদের একক শক্তি সম্পর্কে জানান দিতে চায়। সে কারণে এই বিভাগীয় সমাবেশে জামায়াতসহ তাদের শরিক দলগুলোর কোনো সহযোগিতা নেবে না বলেও জানিয়েছেন দলটির স্থানীয় নেতারা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিভাগে বিএনপি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়। দেশজুড়ে ঘোষিত বিভাগীয় গণসমাবেশের শেষ দিকে এসে সরকারের প্রতিবন্ধকতা বাড়তে পারে। তাই আঞ্চলিকভাবে শক্তি ও সামর্থ্য বিবেচনায় ঢাকার মহাসমাবেশের আগের সমাবেশটি রাজশাহীতে করার কৌশল নিয়েছেন তারা। রাজশাহী অঞ্চলে বিএনপি অনেক বেশি শক্তিশালী। জনসমর্থন ও কর্মী সবকিছু মিলে বিএনপির অন্য কোনো দলের প্রয়োজন নেই।

জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বাংলানিউজকে বলেন, যেহেতু রাজশাহীতে গণসমাবেশ শেষের দিকে তাই সরকার সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা আরও বাড়তে থাকবে। ঢাকার সমাবেশের আগে সরকার কঠোর অবস্থানে যেতে পারে। শক্তি-সামর্থ্যের বিচারে রাজশাহীতে আমাদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী। এসব বিবেচনা করে রাজশাহীতে শেষের দিকে গণসমাবেশ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হবে রাজশাহীতে। সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীকে দাওয়াত দেওয়া কিংবা তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করা হবে না।

এদিকে সমাবেশ ঘিরেই ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজশাহী অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। হঠাৎ করে বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণসহ সমাবেশ-পাল্টা সমাবেশকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। এরইমধ্যে দায়ের হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা।

বিএনপির নেতাকর্মীরা দাবি করছেন, গণসমাবেশকে টার্গেট করে প্রশাসন দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা সাজানো হচ্ছে। সেসব ঘটনায় মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন, গণসমাবেশকে সামনে রেখে বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা অপতৎপরতায় মাঠে নেমেছে। তাদের পাল্টা জবাব দিতে আওয়ামী লীগও প্রস্তুত আছে।

বিভাগীয় সমাবেশের সমন্বয়কারী ও বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহীন শওকত খালেক বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলাতে প্রশাসন আক্রমাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এটি খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। শান্তি বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কর্মসূচি বিএনপি পালন করছে না। গণসমাবেশ সফল করতে প্রচার-প্রচারণা, পথসভা ও হ্যান্ডবিল বিতরণের মাধ্যমে নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছে। মানুষের কাছে পৌঁছানোর বিষয়টা সরকারের কাছে চক্ষুশূল হয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করছে। তারা গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িতে থাকতে পারছে না।

রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদ বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে ধরপাকড় শুরু করেছে। গভীর রাতে তারা নিজেরাই ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করছে। মূলত তারা চেষ্টা করছে সমাবেশে যেন জনসমাগম কম হয়। মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করার জন্য তারা এসব করছে। তবে আমি মনে করি মানুষ এতে আতঙ্কগ্রস্ত নয়। এদেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকার ফেরানোর জন্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ও সরকারের পতন ঘটাতে আগামী ৩ ডিসেম্বরের গণসমাবেশে আসবে। এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

ঢাকার আগে এই বিভাগীয় গণসমাবেশ প্রশ্নে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সাবেক মেয়র ও সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিনু বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহী এখনও বিএনপির দুর্জয় দুর্গ। আমরা বহু ঘাতপ্রতিঘাত মোকাবিলা করেছি। এখন আমাদের আর কোনো ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে যাচ্ছি। আমরা জনগণের জন্য রাজনীতি করি। জনতার উত্তাল আওয়াজে যখন পরিবর্তনের ঢেউ ওঠে তখন সবকিছু একই নদীর স্রোতে ভেসে যায়, সাগরে মিশে যায়। রাজশাহীর গণসমাবেশে তারই সূত্রপাত হবে। যতই বাধা আসুক কম করে হলেও ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে। এমন জনস্রোত তৈরি হবে যে পুরো রাজশাহী শহরই তা ছড়িয়ে পড়বে। অনেক ঘটনার সূতিকাগার এই রাজশাহী থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে।

এদিকে গণসমাবেশ ঘিরে বিএনপির কৌশল নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয় বলছে ক্ষমতাসীন  আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, বিএনপি আত্মতৃপ্তি পেতে পারে যে ৮টি জেলা থেকে সমাবেশে লক্ষাধিক লোক এসেছে। লক্ষাধিক লোক দিয়ে তো আসলে আওয়ামী লীগের মতো একটি বটবৃক্ষের পাতা ছেড়াও সম্ভব না। আর বিএনপি কোথাও বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে সেটি প্রতিহত করার প্রস্তুতি আমাদের আছে। আমরা কোনো মারামারিতে লিপ্ত হতে চাই না। সেটা আওয়ামী লীগের কাজও নয়। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে আমরা জনগণকে নিয়েই সমস্ত অরাজকতা প্রতিহত করবো।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২২
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।