ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

আদানির চুক্তি ছিল সব আধা আধা

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২৪
আদানির চুক্তি ছিল সব আধা আধা

ঢাকা: উচ্চ মূল্য ও অসম শর্তে বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘আদানি পাওয়ার’ লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। অসম্পূর্ণ ও নিয়ম বহির্ভূত চুক্তি সই হওয়ার কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির বোঝা ভারী হচ্ছে।

যে দায় বড় সময় ধরে বহন করতে হবে।

আদানি পাওয়ারের চুক্তি ছিল সব আধা আধা - এমনটাই মন্তব্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।

শুরুতে চুক্তিটি গোপনে সম্পন্ন হয়। এজন্য বিষয়টি পুরোই অন্ধকারে ছিল। দেশের বিদ্যুৎ খাতে আদানি গ্রুপের ব্যবসার পথ সুগম হয় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়। এর দুই বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশের বিপিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করে।  

এ ক্রয় চুক্তির ১৬৩ পৃষ্ঠার একটি নথি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেশের বাইরে থেকে ফাঁস হয়। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কয়লার দাম বেশি রাখাসহ এর বিভিন্ন অসম ধারার তথ্য বের হয়ে আসে। যার ফলে প্রতি বছর বিপুল টাকা বাড়তি গুনতে হবে।

দর কষাকষি না হওয়া, গোপনে চুক্তি সম্পন্ন ও গোপন রাখার কারণে এ চুক্তিকে রাজনৈতিক স্বার্থে অসম্পূর্ণ চুক্তি হিসেবে অবহিত করেন বাংলাদেশের পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তি শেখ হাসিনার আগ্রহে ভারতের প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। সরকার এ চুক্তি পর্যালোচনা করতে কমিটি গঠন করেছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার করার পর চুক্তি বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।  

চুক্তি স্বাক্ষরে প্রয়োজনীয় ধাপ অনুসরণ করা হয়নি

রাষ্ট্রীয় এত বড় চুক্তি সই হলেও প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা ও ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়নি, মানা হয়নি নিয়মাচার। নিয়ম অনুযায়ী, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল স্বাক্ষরের আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতামত নেওয়ার কথা। চুক্তির খসড়ার ওপর মতামত দিতে সরকারের অন্য কোনো দপ্তরে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ২০২২ সালের শেষের দিকে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তির বিষয়টি।

আদানির বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে পাওয়া গেছে নানা অনিয়ম। ভারতীয় ওই কোম্পানির বিদ্যুৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের যে রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তা কোনো শুল্ক স্টেশনই নয় বলে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এ ছাড়া, করমুক্ত আমদানি নীতি, কয়লার বাড়তি দর, বিলম্বে বিল পরিশোধে অতিরিক্ত সুদ আরোপের জটিলতাসহ নানান অনিয়ম বের হয়ে আসছে।

চুক্তিতে কী আছে?

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। কত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ নেবে প্রতি তিন মাস পর পর  তা আগেই ঘোষণা করতে হবে। যদি বাংলাদেশ কম বিদ্যুৎ নেয় তাহলেও ঘোষিত পরিমাণের সমান দাম পরিশোধ করতে হবে। এই কেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের কম বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। কম বিদ্যুৎ নিলে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো, তার দাম ও কয়লা পরিবহন ব্যয়ের অর্থ দিতে হবে। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কয়লার সিস্টেম লস ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ।  

গত অর্থবছর আদানির কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে প্রায় ৮১৬ কোটি ৬৬ লাখ ৭৭ হাজার ইউনিট। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পড়েছে ৬ টাকা ৬০ পয়সা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন (ওঅ্যান্ডএম) খরচ ১ টাকা। জ্বালানি (কয়লা) খরচ প্রতি ইউনিটের জন্য ৭ টাকা ৫৪ পয়সা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ আদানির বিদ্যুৎ কেনায় গড়ে ব্যয় হয়েছে ১৫ টাকা ১৪ পয়সা।

এসব শর্ত অন্য কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে মানা হয়নি।

যে কারণে চুক্তি অসম্পূর্ণ

আদানি পাওয়ারের সাথে চুক্তিকে মূলত অসম্পূর্ণ চুক্তি বলে অবহিত করেছেন বিডি রহমতুল্লাহ। তিনি বলেন, দেশের বাইরে (ক্রসবর্ডার) থেকে পাওয়ার কিনতে হলে আন্তর্জাতিক টেন্ডার করতেই হবে; সলিসিটিতে যেতেই হবে। কিন্তু তা করা হয়নি। ভারত থেকে আমরা এটা কিনছি, এমন না যে এটা ফিক্সড প্রাইজ। যেমন হাইড্রো, এটা ফিক্সড প্রাইজ, সোলার ফিক্সড প্রাইজ।

তিনি বলেন, প্রথম: কয়লাতে বেশি দাম ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের স্টেশন করতে হলে প্রাইস সিলেকশনের একটি ব্যাপার আছে। এটা আইনত। পাওয়ার সেক্টরে থাকা অবস্থায় আমরা এটা করেছি। সেটি কোন জায়গায় বসাবেন- এটা উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। তৃতীয়ত, ট্যারিফ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি করতে হবে। চুক্তিতে এটাও করা হয়নি। যেটা হয়েছে সিঙ্গেলম্যান কমিটি করা হয়েছে। দুইপক্ষের একজন একজন করে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। আদানি বলেছেন, আমি একটি পাওয়ার স্টেশন বসাব, শেখ হাসিনা বলেছেন বসান। ব্যস বসিয়ে দিল।

চুক্তিতে দর কষাকষি হয়নি

এ ধরনের চুক্তির আগে দর কষাকষির সুযোগ থাকা প্রয়োজন। যা আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সই করা চুক্তিতে রাখা হয়নি। আদানি পাওয়ারের প্রস্তাবে কোনো ধরনের দর কষাকষি ছাড়াই সই করেছে বিপিডিবি। এর মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশের কর্তৃত্ব সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। দাম ও চুক্তি করার সময় শর্ত সমূহ প্রতিকূল হওয়ার কারণে দেশের মানুষের ব্যয়ভার বাড়ানো হয়েছে। দর কষাকষির মাধ্যমে চুক্তি করা গেলে এটা কমানো সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটা করা হয়নি।

চুক্তি রিভিউ করতে কমিটি

চুক্তি রিভিউ করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রিভিউ কমিটি করেছে। কমিটি খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করছে। দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় কমিটির পর আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার প্রয়োজন বলে মনে করেন পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমতুল্লাহ।  

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদনের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদা আড়াইগুণ বেশি উৎপাদন ক্ষমতা। সেখানে কিছু নষ্ট থাকতেই পারে। সেগুলো মেরামত করতে হবে। আর এই সংস্কারের জন্য বাংলাদেশে বহু লোক আছে। সরকারের লোকজন সৎ, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এ সম্পর্কিত জ্ঞান ও প্রতিশ্রুতির অভাব রয়েছে। সরকারকে অ্যাগ্রেসিভও হতে হবে।  

এখন যেটা প্রয়োজন, চুক্তি পর্যালোচনার এটা বাতিল করা। তবে হ্যাঁ, নেপাল থেকে যে হাইড্রো পাওয়ার আনার চুক্তি হয়েছে, সেটা ভালো হয়েছে। কম পয়সা, বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমে বিদ্যুৎ আসছে। দেশে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে আছে প্রয়োজন ছিল এগুলো লোড ম্যানেজমেন্ট করে উৎপাদনে করা যেত।  

এটা না করে বিদ্যুৎ আমদানির দিকে যাওয়া হয়েছে, বলেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।  

আদানি পাওয়ার থেকে কেনা বিদ্যুৎ মূল্য পরিশোধের বিষয়টি এখন সামনে চলে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যেও বিপুল পরিমাণ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ আদানি পাওয়ারের পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। এক্ষেত্রে আদানি পাওয়ারকে প্রতি মাসে ১০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বিপিডিবি সূত্র জানিয়েছে।  

এ বছরের জুলাইয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ, আগস্টে ২ কোটি, সেপ্টেম্বরে ৬ কোটি ৫০ লাখ, অক্টোবরে ৯ কোটি ৭০ লাখ এবং চলতি নভেম্বরে ৬ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে আদানিকে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে আদানি পাওয়ারের ২৫ কোটি ডলারেরও বেশি বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে।

আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আদানিসহ বিদ্যুৎ খাতের অসম চুক্তিগুলো পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই আবারও বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিল বাবদ পাওনা পরিশোধ নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়। এই জটিলতা বিদ্যুৎ আমদানিতে চুক্তি সম্পূর্ণ করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২৪
জেডএ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।