ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র

ছাই ও দূষিত পানিতে চর্মরোগ

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও মোস্তাফিজুর রহমান বকুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১২
ছাই ও দূষিত পানিতে চর্মরোগ

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে: দিনাজপুরকে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট (কয়লা ভিত্তিক) বিদ্যু‍ৎ কেন্দ্র। দৈনিক হাজার হাজার লিটার দূষিত পানি মিশে নদী যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনি চিমনিতে ইএসসি না থাকায় ক্ষতিকারক ছাই মারাত্মক ক্ষতি করছে পরিবেশের।



পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারের মধ্যে বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। পানি দূষণের কারণে নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষিত পানি-বয়ে-যাওয়া তিলাই নদীতে মাছও বাঁচতে পারছে না বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।

বস্তুত ভয়াবহ আকারে পানি দূষণ করছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। কেন্দ্রটির দূষিত পানি সরাসরি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তিলাই নদীতে। তিলাই নদীর পানি গিয়ে পড়ছে ছোট যমুনায়। এই দুই নদীর উপর নির্ভরশীল কয়েক লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগে।

তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মঞ্জুরুল হক বাংলানিউজকে জানান, পানি শোধন করে নদীতে দেওয়া হচ্ছে। এতে খুব একটা ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে  তিনি বলেন, ‘‘সেখানে তো নদীই নেই। রয়েছে মাত্র একটি মরা খাল। ”

দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যু‍ৎকেন্দ্রটির ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতার কারণে শুরু থেকেই নানা বিপর্যয় লেগে আছে। পরিবেশ দূষণ রোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল তার অনেকটাই অনুপস্থিত। স্থানীয়রা তাদের ক্ষতির কথা কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে বের হতে পারছে না দীর্ঘদিন ধরে। বর্তমানে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায় ২শ’ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে দৈনিক প্রায় ২ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। যা থেকে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ ছাই তৈরি হচ্ছে। ফলে দৈনিক ছাই তৈরি হচ্ছে ২৪০ টন।

২৪০ টন ছাইয়ের মধ্যে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৯২ টন ছাই চিমনি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছাই ঠেকানোর জন্য ইএসপি (Electrostatic precipitators) ব্যবহার করার কথা। দু’টি ইএসপির মধ্যে একটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল পড়ে রয়েছে। এ কারণে যখন চালু ইএসপি পরিষ্কার করার প্রয়োজন হচ্ছে তখন ছাই সরাসরি চলে যাচ্ছে বাতাসে।

ইএসপি নষ্ট থাকার কথা অস্বীকার করে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রর প্রধান প্রকৌশলী মঞ্জুরুল হক বাংলানউজকে জানান, কিছু সমস্যা রয়েছে। দিনে দু’বার বোরিং করতে হয়। তখন ছাই বাতাসে চলে যায়। তা ছাড়া অন্য সময় ছাই তেমন একটা যায় না।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিষাক্ত ছাই বাতাসের সঙ্গে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে বলে দাবি করেন দধিপুকুর গ্রামের বাসিন্দা মজিবর রহমান।

বাংলানউজকে তিনি জানান, মাঝেমধ্যে ছাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঘরের বাইরে  একঘণ্টা দাঁড়ালে শরীর ছাইয়ে ভরে যায়। আমরা অনেকবার বলেছি, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

বাতাসে ছাই উড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিচ দিয়ে যে ছাই পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোও জমা করা হচ্ছে তিলাই নদীর পাড়ে। সেখান থেকে বিষাক্ত ছাই বাতাস ও বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে।

বড়পুকুরিয়া পানি বিদ্যুৎ ও কর্মসংস্থান আদায় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ওবায়দুল হক বাংলানউজকে জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কারণে এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আমরা বলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ নিজ উদ্যোগে পথে নেমে আসবে।

তিনি দাবি করেন, দ‍ূষিত পানি ব্যবহারের কারণে গ্রামের (রামভদ্রপুর) অনেক লোক বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এরইমধ্যে গ্রামের আফসার আলীর পুত্র আমিনুল শওকত আলীর স্ত্রী মোর্শেদা বেগমসহ অনেকে চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

ওবায়দুল হক দাবি করেন, ছাইয়ের কারণে এলাকায় বাঁশের উৎপাদন কমে গেছে। ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে বাঁশ বাগান। আগে আমন মৌসুমে এক বিঘা (৫০ শতক) জমিতে ২৪ থেকে ২৬ মণ ধান উৎপাদন হত। এখন সেখানে ধান উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১৬ মণ।

ওবায়দুল হক দাবি করেন, তিলাই নদীতে কোনো মাছ বাঁচতে পারে না। নদীর পানি সবুজ রঙ ধারণ করেছে।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, কেন্দ্রটির প্রধান প্রকৌশলীর অদক্ষতা ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতার কারণেই এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। তেমনটি হলে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যু‍ৎকেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

উল্লেখ্য, ১২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার দু’টি ইউনিট রয়েছে কেন্দ্রটিতে।   দু’টি ইউনিটেরই ইন্সট্রাকটর, কম্পিউটার রুমের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও আইডি ফ্যানসহ কম্পিউটার রুম, যান্ত্রিক রুম, রিলে রুম, ব্যাটারি চার্জিং রুম, টারবাইন ডিসিএস এবং কম্পিউটার মনিটর অপারেটিং সিস্টেমে ত্রুটি রয়েছে।

প্রতিবার মেরামতের সময় অরিজিনাল যন্ত্রাংশ কেনার নামে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ কিনে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এতে করে দফায় দফায় মেরামত করেও স্থায়ী ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, আনসার ও সরকারের একটি বিশেষ বাহিনীর তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তার ভেতর থেকে কয়েক দফায় চুরির ঘটনা ঘটলেও প্রধান প্রকৌশলী রয়েছেন নিরব। এক্ষেত্রে তার সঙ্গে গোপন আঁতাত থাকতে পারে বলেও কর্মচারীরা মনে করেন।

তবে প্রধান প্রকৌশলী সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১২
ইএস/ সম্পাদনা: জয়নাল আবেদীন, নিউজরুম এডিটর/জেডএম; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।