ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

দুর্ভোগে নগরবাসী

চুলা জ্বলছে না, বন্ধ সিএনজি স্টেশন

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৩
চুলা জ্বলছে না, বন্ধ সিএনজি স্টেশন

ঢাকা: গ্যাস সংকটে নাকাল রাজধানীবাসী। দিনের অধিকাংশ সময়ই থাকছেনা গ্যাস সরবরাহ।

যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন চুলা জ্বলছে মোমবাতির মতো। এছাড়া গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে সিএনজি স্টেশন বন্ধ থাকছে প্রায়ই।

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা রাজধানীর বনশ্রী এলাকায়। এই এলাকায় কয়েক মাস ধরেই দিনে গ্যাস সরবরাহ থাকছে না বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।

রামপুরা বনশ্রী সি ব্লকের বাসিন্দা পপি বেগম বাংলানিউজকে জানান, “গ্যাস সংকটের কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে রাজধানী ছেড়ে পালাতে পারলে শান্তি পেতাম। ”

তিনি বলেন, “বুধবার ঘুম থেকে উঠে সকাল ৭টায় রান্না ঘরে গেছি নাস্তা করতে। চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখি গ্যাস নেই। বাধ্য হয়ে শুকনা খাবার খেয়েই অফিসে ছুটতে হয়। সন্ধ্যা ৬টায় এসেও দেখি গ্যাস নেই। এর কিছুক্ষণ পর আসে গ্যাস। ”

তিনি দাবি করেন, “মাত্র ৪০ মিনিট গ্যাসের সরবরাহ ভালো থাকলেও এরপরে কমতে থাকতে গ্যাসের চাপ। রাত ৯টায় গিয়ে একেবারেই কমে যায়। রাত ১২টার আবার স্বাভাবিক হয় সরবরাহ। ”

বনশ্রী এলাকায় এর আগে কখনো এতো খারাপ পরিস্থিতি হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

একই ব্লকের ২নং রোডের ২৩/২৫ নং বাসায় থাকেন বিদেশে উচ্চ শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ডিসিএস এডুকেয়ারের স্বত্ত্বাধিকারী মো: রেজাউল করিম। গ্যাস সংকট নিয়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন একই কথা।

দিনে গ্যাস না থাকার কারণে বাসার বুয়া রাতেই সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার রান্না করে যায় বলেও জানান এ  ব্যবসায়ী।

বনশ্রী ডি ব্লকের বাসিন্দা গৃহিণী সালমা চৌধুরী বলেন, “সকালে গ্যাস সরবরাহ থাকে না। তাই আগের রাতেই রান্না করে রাখতে হয় সব খাবার। এখন আমরা বাসি খাবারে অভ্যস্থ হতে বাধ্য হয়েছি। ”

যে কোন সময়ের চেয়ে গ্যাস সংকট বেশি দাবি করে তিনি বলেন, “দিনের কোনো সময়েই তারা গ্যাস পাচ্ছি না। সন্ধ্যার দিকে কিছুক্ষণের জন্য আসে। তখন চাপ থাকে খুবই কম, যাতে রান্না করা খুবই কঠিন। ”

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায়ও এ সংকটের খবর পাওয়া গেছে। ইনার সার্কুলার রোডের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দিনে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা সন্তোষজনক থাকে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে গ্যাসর চাপ। বেলা ১১টার দিকে চাপ কমে গিয়ে আর রান্নার উপযোগী থাকে না।

মোহাম্মদপুর নুরজাহান রোডের (৫১/সি) মোদাব্বেরুল ইসলাম সাজু বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের এই এলাকায় কয়েকদিন ধরেই গ্যাসের চাপ কমে গেছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় আছি, এর আগে কখনও এমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। ”

মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৮ নম্বর রোডের (বাড়ি#১০৯) বাসিন্দা গৃহিণী সাকিলা ইসলাম জানান, “দিনে যে সময় গ্যাসের প্রয়োজন তখন গ্যাসের দেখা পাওয়া যায় না। রাতে যখন গ্যাসের প্রয়োজন থাকে না তখন ঠিকই থাকে। ”

তিনি আরও বলেন, “গ্যাস সকাল ৯টার মধ্যেই চলে যায়। দুপুর ২টার দিকে কিছু সময়ের জন্য আসে। আবার বিকেলের দিকে চলে যায়, আসে অনেক রাতে। এতে করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ”  

এদিকে রাজধানীর দনিয়া, নবীনগর, কমিশনার রোড, নামাশ্যামপুর, পাটেরবাগ ও মুরাদপুর এলাকায় দিনের বেলা গ্যাস সরবরাহ থাকেনা বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এসব এলাকায়  গভীর রাতে গ্যাস এলে চলে রান্নার কাজ। রাতের রান্না করা খাবার দিয়েই বাসিন্দাদের চালাতে হয় সারাদিন।

দনিয়া এলাকার বাসিন্দা সুলতান মাহমুদ বলেন, “দিনের বেলা কোন আত্মীয় বাসায় এলে লজ্জার সীমা থাকেনা। হয় হোটেল থেকে এনে আপ্যায়ন করাতে হয়, নইলে না খাইয়েই বিদায় করতে হয়। ”

বেশ কিছুদিন ধরেই গ্যাস সংকট চলছে বলে জানান মিরপুর কচুক্ষেত (১৪ নম্বর) এলাকার বাসিন্দা আব্দুলাহ আল মামুন লিটন। তারা প্রথম প্রথম মনে করেছিলেন কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে, দুয়েকদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সঙ্কট না কমে দিনদিন আরও বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে দিনের অনেক সময়েই সিএনজি স্টেশন বন্ধ থাকছে। বছরের প্রথম দিনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর পল্টন এলাকার এনার্জি প্লাস সিএনজি স্টেশন বন্ধ থাকতে দেখা গেছে। এনার্জি প্লাস সিএনজি স্টেশনের শিফট ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ মিয়া জানান, দু’সপ্তাহ যাবৎ দুপুরে দিকে গ্যাস থাকে না লাইনে।

তিনি আরও বলেন, “সকাল ৯টায় বিদ্যুৎ চলে যায় আর আসে বিকেল ৩টায়। এতে কিছুক্ষণ চলার পরই আবার চাপ কমে যায়। এরপর আবার রাত ৯টার দিকে কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হয়। ”

পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, “সরকার ঢালাওভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। অনেক ক্ষেত্রেই পেট্রোবাংলার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। ”

২০১৬ সাল নাগাদ আরও ১১টি গ্যাস ভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চায় সরকার। এতে দৈনিক বাড়তি গ্যাস প্রয়োজন পড়বে আরও ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ কারণে ভবিষ্যতে গ্যাস সংকটের বাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ইউনিট প্রতি ১৮ টাকার মতো খরচ হয়। তাই সরকার সাশ্রয় করতে গ্যাস দিয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

রাজধানীর গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্টিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আজিজ খানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।

পেট্রোবাংলার চেয়ার‌ম্যান ড. হোসেন মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, “শীতের কারণে গ্যাসের প্রেসার স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়, যে কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই সংকট দূর হয়ে যাবে। ”

পেট্রোবাংলা সংকট কমিয়ে আনতে তৎপর রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে গ্যাস সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিং নগরজীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। জানুয়ারি মাসে (শীতের কারণে) বিদ্যুতের সর্বনিম্ন চাহিদা থাকলেও দিনে দুই থেকে চারবার, কোথাও ৫/৭ বার করে লোডশেডিং হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বুধবার সর্বমোট ২ হাজার ২১৪ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১ হাজার ২২৬ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ৭২৫ মিলিয়ন ঘনফুট, ক্যাপটিভ পাওয়ারে সাড়ে ৫৬ এমএমসিএফ, সার উৎপাদনে ২৮৯ এমএমসিএফ চাহিদার বিপরীতে ১৯৭ এমএমসিএফ এবং অন্যান্য গ্রাহকদের ১ হাজার ২১০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৩
ইএস/সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর; নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।