ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

অটবির অকেজো বিদ্যুৎকেন্দ্র

৭৮৪ কোটি টাকায় ভাড়া করছে পিডিবি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪
৭৮৪ কোটি টাকায় ভাড়া করছে পিডিবি

ভেড়ামারা থেকে ফিরে: অটবি গ্রুপের বিকল বিদ্যুৎকেন্দ্র ৭৮৪ কোটি টাকায় ভাড়া নিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড(পিডিবি)। অটবির প্রস্তাবটি এরই মধ্যে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে।

যে কোনো সময়ে চুক্তি সম্পাদন হতে পারে বলে জানিয়েছে পিডিবি।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৬০ মাসের জন্য ভাড়া করা হচ্ছে। আর মাসে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ভাড়া ধরা হয়েছে ১৫.৯৬ ডলার। সে হিসেবে প্রতি মেগাওয়াটে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে ১৫ হাজার ৯৬০ ইউএস ডলার।

আর ১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য মাসে ভাড়া গুনতে হবে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮‘শ ডলার। সর্বমোট ৬০ মাসে পিডিবির ভাড়া দিতে হবে ১০ কোটি ৫ লাখ ৪৮ হাজার ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় (ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) ৭৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৪৪ হাজার।
 
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগের বার ৩ বছরের জন্য ভাড়া করা হয়েছিলো। তখন ভাড়া ধরা হয়েছিলো ৫৬৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দফায় ভাড়া কম হওয়ার কথা। কিন্তু অটবির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ মহলের নির্দেশে—এমন অভিযোগ আছে।
 
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, অটবি তো আগেই তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে। এখন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ হওয়ার কথা।
 
তিনি বলেন, তারা দস্যুতা করে জনগণের টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মূলত তারা সরকারের লোক। সে কারণে তাদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে লুটপাট করার জন্য।
 
বিডি রহমতউল্লাহ দাবি করেন, ‘অটবি ১৯৮৯ সালের তৈরি একটি পুরাতন মেশিন ঘষা-মাজা করে এনেছে। আমি হলফ করে বলতে পারি ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মূল্য কোনোভাবেই ১০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে না। ’
 
তিনি বলেন. অটবি তো আগেই অনেক টাকা মুনাফা করেছে। এখন আবার ভাড়ার প্রশ্ন আসছে কেন? তারা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ অপরেশন কস্ট নিতে পারে। কিন্তু সেই টাকা মাসে কোনোভাবেই ৫০ লাখের বেশি হতে পারে না।
 
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সাধারণত একটি স্থায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইফ টাইম(আয়ুষ্কাল)২৫ বছর হয়। সেগুলো নির্মাণে প্রতি মেগাওয়াটে ৬-৭ কোটি টাকা খরচ হয়। সে হিসেবে অটবির ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মতো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ৬ থেকে ৭‘শ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়।
 
ওই রকম একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পিডিবি ২৫ বছর বিদ্যুৎ পেতে পারতো। এমনকি আরও অতিরিক্ত ১৩ বছর অর্থাৎ ৩৮ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের নজীর রয়েছে বাংলাদেশেই।
 
অথচ মাত্র ৮ বছরে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য ভাড়া পরিশোধ করা হচ্ছে ১ হাজার ৩৫১ কোটি টাকার মতো। কার স্বার্থে জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে প্রশ্ন তোলেন বিডি রহমতউল্লাহ।
 
১১০ মেগাওযাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এর আগের দফায় ৩ বছরের জন্য ভাড়া করা হয়েছিলো। অটবি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম লিমিটেডের সঙ্গে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের পর পরীক্ষামূলকভাবে চলার সময় সর্বোচ্চ ৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন করতে সক্ষম হয়।
 
কথা উঠেছিল তাদের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার। গোপন দফার রফার মাধ্যমে মাত্র ৫ মেগাওয়াট কম দেখিয়ে বিদ্যৎ কেন্দ্রটির ক্ষমতা নিরূপণ করা হয় ১০৫ মেগাওয়াট—এমন অভিযোগও রয়েছে।
 
তাদের মেয়াদকালে কোনোদিনই যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে বের হতে পারে নি। ১৪টি ইউনিটের মধ্যে এক নম্বর ইউনিটটি একদিনও চালানো যায় নি।
 
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির হেলপার মিলন বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, মোট ১৪টি ইউনিট রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে। একেকটি ইউনিটের ওজন প্রায় ১১০ মেট্রিক টন। এক নম্বর ইউনিটটি বসানোর সময় হাইড্রোলিক ফেল করে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙ্গে গেছে। ওই মেশিনটি আর চালু করা হয় নি।
 
অপর একজন টেকিনিশয়ান বাংলানিউজকে জানিয়েছে ওই সময়ে একটি ট্রাকও ভেঙ্গে গেছে। আর একজন শ্রমিকও মারা গেছে। ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে ওই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হয়।  
 
মিলন আরও জানান, এক বছর চলার পর ১৪ নম্বর ইউনিটটির ভেতরের বুস্টার ভেঙ্গে যায়। আর তখন থেকে সেটিও পড়ে রয়েছে।
 
এখানে শেষ নয়। পিডিবির আইপিপি সেল-১ সুত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ৩টি টারবাইন আনার কথা ছিল। কিন্তু আনা হয় মাত্র ২টি টারবাইন। ডিজেলচালিত জেনারেটর থেকে নির্গত ধোঁয়া দিয়ে টারবাইনগুলো ঘোরানোর কথা। আর সেখান থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
 
কিন্তু একটি টারবাইন আমদানিই করা হয় নি। আর দু’টি টারবাইন আনা হলেও তাদের মেশিন নষ্ট থাকায় কোনদিনই এক সঙ্গে ৭টি মেশিন চালাতে পারে নি অটবি। সে কারণে কোনোদিনই টারবাইন দু’টি চালাতে পার নি তারা।
 
টারবাইন না চালানোর বিষয়টি ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাধিক টেকনিশিয়ান নিশ্চিত করেছেন।
 
ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপারেশন ইনচার্জ মনিরুজ্জামান বাংলানিউজের কাছে এক নম্বর ইউনিটটি ভেঙ্গে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
 
তিনি বলেন, গত বছরের মার্চ মাস থেকে আমাদের বিল প্রদান বন্ধ রেখেছে পিডিবি। তাই মেশিনগুলো মেরামত করা যাচ্ছে না। এমনকি লুব ওয়েল কেনা যাচ্ছে না।
 
কুইক রেন্টালের চুক্তি নবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ পর‌্যায়ের কমিটি করা হয়েছিলো। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন যুগ্ম সচিব আনোয়ার হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, ‘যেহেতু মাঝারি আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি উৎপাদনে আসে নি, সেহেতু এখনই কুইক রেন্টাল বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। ’

তাই অটবির ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। আগের চেয়ে ভাড়ার হার কমানো হয়েছে বলেও দাবি করেন আনোয়ার হোসেন।
 
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অকেজো পড়ে থাকার কথা স্বীকার করে আনোয়ার হোসেন বলেন, তারা আগে সঠিক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে নি। কিন্তু এবার বলেছে পারবে তাই দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।