ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বাপেক্সের গলা চেপে ধরা হয়েছে

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫
বাপেক্সের গলা চেপে ধরা হয়েছে

ঢাকা: ঘটনাটা এমন দাঁড়িয়েছে, সব অবিচার বাপেক্সের সঙ্গে। একচুল ছাড় নয়, বরং সবদিক থেকে চেপে ধরা হয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিটিকে।


 
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা এমন মন্তব্য করেছেন। বাপেক্সকে রক্ষার জন্য সমতা নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা। বাড়তি সুবিধা নয়, অন্তত বহুজাতিক কোম্পানির সমান সুযোগ দিতে, না হলে বাপেক্সের বিপর্যয় অনিবার্য বলেও মনে করেন তারা।
 
রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিটি সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সেমুতাং, সুন্দলপুর, শ্রীকাইল ও বেগমগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড থেকে দৈনিক ১৩৩.৪ মিলিয়ন ঘনফুট (৩ আগস্ট) উত্তোলন করছে। প্রতি হাজার ঘনফুটের জন্য ২৫ টাকা হারে পরিশোধ করা হয়। তখন একই পরিমাণ গ্যাস বাবদ বিদেশি কোম্পানিকে ২৩০ টাকা (২.৯৮ ডলার) দিচ্ছে পেট্রোবাংলা।
 
আবার গভীর সমুদ্রের গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২৫ টাকা (৪.১৬ ডলার)। ২০১৪ সালের পিএসসি (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) অনুযায়ী হবে ৫৪০ টাকা (প্রায় ৭ ডলার)।
 
শুধু গ্যাস দর ইস্যুতে পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি। বাপেক্সকে দেওয়া দরকে নামমাত্র মূল্য বলে অভিহিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে দিনে দিনে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে বাপেক্স। হারিয়ে ফেলছে তাদের সক্ষমতা।
 
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বাপেক্সের উৎপাদন খরচ প্রায় ৬০ টাকার মতো পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে মাত্র ২৫ টাকা হারে পরিশোধ করা হচ্ছে।
 
তিনি বলেন, আমলাদের বিদেশি কোম্পানির প্রতি দরদ অনেক বেশি। কিন্তু দেশীয় কোম্পানির প্রতি তাদের কোনো দরদ নেই। এখানে মূল্য বাড়াতে তাদের খুবই কষ্ট হয়। তখন নানান যুক্তি বের করেন আমলারা।
 
বাপেক্স সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে গ্যাসের দাম ‍বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবে প্রতি হাজার ঘনফুটের মূল্য ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এখনই ৬০ টাকার মতো উৎপাদন খরচ পড়ছে। অন্যদিকে গাজপ্রমকে ‌দিয়ে উচ্চদরে কূপ খনন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। যা গিয়ে যুক্ত হবে উৎপাদন খরচে।
 
গ্যাস উৎপাদনে প্রধান ‍কাজ করছে বাপেক্স। কিন্তু ‍তাদের মুনাফা না বাড়িয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর মুনাফা দিন দিন ‍বৃদ্ধি করা হচ্ছে। একে গাছের গোড়া কেটে মাথায় পানি দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন বাপেক্সের কর্মকর্তারা।
 
বাপেক্সের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত অর্থ বছরে বিতরণ কোম্পানির কর্তা থেকে ঝাড়ুদার পর্যন্ত ৬ লাখ টাকা করে প্রফিট বোনাস পেয়েছেন। কিন্তু বাপেক্সের লোকজন পাবে কি-না তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এতে ‍বাপেক্সকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে।
 
বাপেক্সের কর্মীরা বলেন, আমরা খেটে মরি। আর সেই গ্যাস পাইপলাইনে সাপ্লাই করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) কর্মীরা বছরে ৬ লাখ টাকা প্রফিট বোনাস পায়। শুধু তাই না পেট্রোবাংলার লোকজন চিঠি চালাচালি করেও আমাদের চেয়ে কয়েকগুন বেশি প্রফিট বোনাস পায়। যে কারণে হতাশা থেকে অনেকেই বাপেক্স ছেড়ে যাচ্ছেন।
 
এখানেই বৈষম্য শেষ নয়। কথা ছিল গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে। কিন্তু তা না করে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে প্রদত্ত ১ হাজার কোটি টাকার ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ঋণের টাকা যে খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে সেখান থেকে সহসা রিটার্ন আসার সুযোগ নেই। ঘোড়ার আগেই গাড়ি জোড়ার মতো অবস্থা।
 
গ্যাস বিক্রির মুনাফা দিয়ে জিডিএফ গঠন করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তখন বলা হয়েছিলো এই তহবিল থেকে দেশীয় কোম্পানিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করা হবে। এতে দেশীয় কোম্পানির সক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু সেই টাকা এখন সুদে খাটাচ্ছে পেট্রোবাংলা। যার হিস্যা প্রফিট বোনাস হিসেবে পকেটে ভরছে পেট্রোবাংলার স্টাফরা। অথচ যাদের মুনাফার অংশে ফান্ড গঠিত তারা সুদ দিয়ে রূগ্ন হয়ে পড়ছে।
 
বাপেক্সের সাবেক এমডি মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বাংলানিউজকে ‍জানিয়েছেন, বাপেক্সকে বাঁচাতে হলে বহুজাতিক কোম্পানির মতো গ্যাসের দর দেওয়া উচিত। একইভাবে পিএসসি করা হোক। তাতে মুনাফা বাড়বে সঙ্গে সঙ্গে সক্ষমতাও বাড়বে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির।
 
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, একেক ফিল্ডে একেক রকম উৎপাদন খরচ পড়ে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দেখে বলতে হবে। তবে এখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
 
বাপেক্সের হিসাব বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বপেক্স যে কাজ করলে ২০০ কোটি টাকা খরচ হতো, সেই কাজের জন্য গাজপ্রমকে ১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বলা যায় ৮শ’ কোটি টাকাই জলে ঢালা হয়েছে। আর সেই টাকার সুদ সমেত গুণতে হচ্ছে। গত মাস থেকে ওই টাকার কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। গ্যাসের দাম না বাড়ালে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লোকসানের মুখে পড়তে পারে বাপেক্স।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৫
এসআই/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।