ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুতের দাম কমাতে আপত্তি নেই পিডিবির!

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৭
বিদ্যুতের দাম কমাতে আপত্তি নেই পিডিবির! বিইআরসিতে ক্যাবের বিদ্যুতের দাম কমানোর আবেদনের ওপর গণশুনানি। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: কনজুমারস্‌ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) অকাট্য যুক্তির কাছে হার মেনেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বলতে বাধ্য হয়েছে, বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। তবে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে।

সরকার যদি প্রতিশ্রুত ভর্তুকির অর্থ পিডিবিকে দেয়, আগে দেওয়া ভর্তুকি সুদসহ মওকুফ করে, তাহলে দাম কমানো সম্ভব বলে স্বীকার করেন পিডিবি’র জিএম (বাণিজ্যিক পরিচালন) কাওছার আমীর আলী।
 
বৃহস্পতিবার (০৫ অক্টোবর) বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) ক্যাবের বিদ্যুতের দাম কমানোর আবেদনের ওপর গণশুনানিতে এ স্বীকারোক্তি দেন কাওছার আমীর আলী।

ক্যাবের হিসেব ও পরিসংখ্যান স্বীকার করে নিতেও বাধ্য হন তিনি।
 
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম হিসেব কষে দেখিয়ে দেন, কিভাবে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কমানো যায়।

তিনি বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার যদি সাশ্রয়ী মূল্যে উৎপাদনে প্রাধান্য দিতো, তাহলে ৭ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো, এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। বরং ইউনিটপ্রতি ১.৫৬ টাকা কমানো যেতো’।
 
শামসুল আলম বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি জ্বালানি খরচ (গ্যাস) ৮৪ পয়সা হলেও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯২ পয়সা। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম কম পড়ে। কিন্তু সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪৩ শতাংশ হারে আর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৭০ শতাংশ হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে’।
 
‘সরকারি ৪ হাজার ৩৯৮ মেগাওয়াটের ৪৩.০৮ প্লান্ট ফ্যাক্টরে উৎপাদিত হয় ১ হাজার ৬৫৯ কোটি ইউনিট। ৭০ শতাংশ হারে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু পিডিবি তা করছে না। এতে বছরে ৭৮০ কোটি ১৪ লাখ টাকা বেশি গুণতে হয়েছে (২০১৬-১৭ অর্থবছরে)’।
 
তিনি বলেন, ‘বিইআরসি’র স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, কম দামে উৎপাদনক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আগে চালাতে হবে। ঘাটতি থাকলে ব্যয়বহুলগুলো চালাতে হবে। কিন্তু বিইআরসি’র এ নির্দেশনা মানছে না পিডিবি। ৪ টাকায় বিদ্যুৎ প্রাপ্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ৩০ টাকা ইউনিট খরচ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে’।
 
 
পিডিবি’র পক্ষে জিএম (বাণিজ্যিক পরিচালন) বলেন, ‘ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলা হলেও ঋণ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিইআরসি যে ভর্তুকি দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে, সেটিও পাইনি। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকায়। যার সুদ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ফলে দিন দিন রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে পিডিবি’।
 
‘সংকট কাটাতে অবচয় তহবিল থেকে ব্যয় পরিচালনা করতে হচ্ছে। অবচয় তহবিলে ২২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা জমা থাকার কথা। কিন্তু জমা আছে মাত্র ৩১৯ কোটি টাকা। অর্থ সংকটে ওভারহোলিং রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ব্যহত হচ্ছে’।
 
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি প্রতিশ্রুত ভর্তুকির অর্থ পাই, আর ভর্তুকির পরিবর্তে দেওয়া ঋণের সুদ বাবদ ইউনিটপ্রতি ২১ পয়সা দিতে না হয়, আর যদি ১৩২ কেভি লেভেলের গ্রাহকদের পিডিবি’র অধীনে ন্যস্ত করা হয়- তাহলে হ্রাসকৃত মূল্যে বিদ্যুৎ বিতরণ করা সম্ভব’।
 
ক্যাব উত্থাপিত সরকারি পাওয়ার প্লান্টে সাশ্রয়ী খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি মেনে নিলেও গ্যাস সংকট ও টেকনিক্যাল কারণে সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য করেন কাওছার আমীর আলী।
 
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ সঞ্চালন সিস্টেমের নিরাপত্তা এবং ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখতে ন্যাশনাল লোড ডিসবার্জ সেন্টারের (এনএলডিসি) নির্দেশনায় ব্যয়বহুল কেন্দ্র চালাতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, খুলনা ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কথা। এটির উৎপাদন খরচ বেশি হলেও সিষ্টেমের নিরাপত্তা ও ফ্রিকোয়েন্সির কারণে চালাতে হয়’।
 
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশি গ্যাস সরবরাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্যাসভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাসফিল্ডের কাছাকাছি। ফলে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, সিলেট ও ভোলা) পাশাপাশি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
 
সাশ্রয়ী মূল্যের বদলে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টিতে পিডিবি’র সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। এখানে এনএলডিসি’র ওপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া সিস্টেমের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মেরিট অর্ডার যথাযথভাবে প্রতিপালন করা সম্ভব হয় না।
 
এ সময় শামসুল আলম পিডিবি এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘আমি প্রমাণ করে দেবো, বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। আসেন বসি, যদি প্রমাণ করতে না পারি তাহলে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং সনদ আগুন দিয়ে পুড়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যাবো। জার্মানিতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমছে। আর আমাদের দিন দিন বাড়ছে’।
 
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ভর্তুকি শব্দটি শুনতে মনে হয়, লিল্লাহ দেওয়া হচ্ছে। বরাদ্দ বলা হয় না কেনো? রাষ্ট্র কি সব সময় ব্যবসা করে! পুলিশ বাহিনীকে যে অর্থ দেওয়া হয়, সেটার কি কোনো রিটার্ন হিসেব করা হয়। সেখানে যদি বরাদ্দ বলা যায়, তাহলে এখানেও বরাদ্দ বলতে হবে’।
 
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘ভর্তুকি দেওয়ার কথা। এখন তার সুদসহ দিতে হবে, ভাবতে অবাক লাগে। এখনতো ভয় হচ্ছে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি সেখানে অনেক ভর্তুকি ছিলো। না জানি আমার মৃত্যুর পর সন্তানদের কাছে সুদসহ দাবি করে  কি-না!’

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সেটি হবে জনগণকে বিদ্যুতের শক দেওয়া’।
 
বক্তারা সকলেই প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের দাম কমানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি নেওয়ায় কমিশনের প্রশংসা করেন। তাদেরকে জনগণের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা পালনেরও অনুরোধ জানান।
 
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া গণশুনানি চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। গণশুনানি নেন বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, সদস্য  মিজানুর  রহমান, আবদুল  আজিজ  খান, রহমান  মুরশেদ ও মাহমুদউল হক ভুইয়া। বাম সংগঠনের নেতা, ব্যবসায়ী নেতা ও বিপুল সংখ্যক ভোক্তা এতে অংশ নেন।

চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘বিইআরসি’র প্রতি প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সবার আবেদন যথাযথভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করবো’।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১৭
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।