ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

একাত্তর

অস্ত্রের ভাষাতেই সূচিত হয় পাকিস্তানিদের পরাজয়

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৬
অস্ত্রের ভাষাতেই সূচিত হয় পাকিস্তানিদের পরাজয়

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তির এ সংগ্রাম ছিল অসম আর্থিক বণ্টন-ব্যবস্থা ও অপ-কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিকদের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই ছিল এর লক্ষ্য।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তির এ সংগ্রাম ছিল অসম আর্থিক বণ্টন-ব্যবস্থা ও অপ-কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিকদের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই ছিল এর লক্ষ্য।

ব্রিটিশ শাসনাবসানের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে যে বৈষম্যের সূচনা হয় তা পরবর্তী ২৪ বছর বহাল থাকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং ২৫ মার্চের কালো রাতে বাঙালি জনগোষ্ঠির ওপর চালানো হয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের সামরিক বর্বরতা। এই নিধনযজ্ঞ বাস্তবায়ন করতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, ব্রিগেডিয়ার আরবাব ও মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে দায়িত্ব দেন ইয়াহিয়া। আর সার্বিক দায়িত্বে থাকেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। এভাবেই বেসামরিক জনগণের ওপর পূর্ণাঙ্গ সামরিক শক্তি প্রয়োগ কর‍া হয়!
 
ফলে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে জাতি ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ‍ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যায় ভারতে। ভারত আমাদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়। ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোতে শরণার্থীশিবির স্থাপন করা হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মানবিক সহায়ত‍া যা সামরিক সহায়তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
 
১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই আমাদের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। কিন্তু শাসকচক্র তারও আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একদিকে আলোচনার নামে টালবাহানা, অন্যদিকে গোপনে সমরাস্ত্র সরবরাহ চলতে থাকে। ’৭১-এর মার্চে ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেলারেল ছিলেন আর্চার সি ব্লাড। আর্চার ব্লাড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি পরিকল্পনাও করেছিলেন। সে পরিকল্পনার বিস্তারিত অবশ্য আর জানা যায়নি। তবে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে পাঠানো তার একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়।
 
‌এভাবেই আলোচনা ভেস্তে যায় আর পাক-বাহিনী নিধনযজ্ঞে নেমে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের বাঙালি জনগণ ও সামরিক বাহিনীর লোকজন যতোটুকু সম্ভব আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
 
টিক্কা খান-রাও ফরমান ‍আলীর ছকমতো এক রাতেই বাঙালি স্তব্ধ হয়ে যায়নি। ফলে ঢাকায় নিধনযজ্ঞ শুরু হলেও প্রতিরোধযুদ্ধ ‍আস্তে আস্তে ঢাকা থেকে সীমান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এভাবেই আমরা একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি।
আগেই বলা হয়েছে, মার্চের প্রথম থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। আর অন্যদিকে পাকিস্তানিরা সেনাবাহিনী, ইপিআর-এর কিছু বাঙালি ইউনিটকে নিরস্ত্র করতে শুরু করে। ২৫ মার্চের পর বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করতে শুরু করে।
 
একটি সর্বাত্মক যুদ্ধকে সফল করতে হলে শুধু সামরিক শক্তির মোকাবেলা করেই হয় না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তারা সেদিন বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে গেছেন।
 
সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই তাজউদ্দীন আহমেদ ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেন তখনকার বিএসএফ প্রধান এফ রুস্তামজি। সেই সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সচিব পিএন হাকসারও তাজউদ্দীনের সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করেন। সব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই তাজউদ্দীন আহমেদ একটি অস্থায়ী বা প্রবাসী বা যুদ্ধকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর ইন্দিরা গান্ধী সবধরনের সহযোগিত‍ার আশ্বাস দেন।
 
যদিও ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের দিন। তবে  এর আগে ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছে, তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে”। তিনি ওইদিন ভারতে জরুরি অবস্থাও জারি করেন এবং পরের দিন (৪ ডিসেম্বর) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণ‍া করে।  
 
আসলে ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ‍ওপর অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করার মাধ্যমেই পাকিস্তানিদের  নৈতিক পরাজয় ঘটে যায়। রাজনৈতিক পরাজয় তো আরো আগেই হয়েছে। সেটি নির্বাচনে পরাজয় ও প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। পরে কূটনৈতিক পরাজয়ও তাদের থলিতে যোগ হয়। সর্বোপরি আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, নৈতিক অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধে মরণপণ লড়াই ও অপরিসীম আত্মত্যাগই আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৬
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।