ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সিঙ্গাপুর

জ্বলন্ত মেরাপি আগ্নেয়গিরির উপত্যকায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৭
জ্বলন্ত মেরাপি আগ্নেয়গিরির উপত্যকায় জ্বলন্ত মেরাপি আগ্নেয়গিরির উপত্যকায়

যুগজাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া থেকে: এখানে এখন বর্ষাকাল। সারাদিন ধরেই টিপটিপ বৃষ্টি হয়। যুগজাকার্তা শহর থেকে মেরাপি আগ্নেয়গিরি উত্তরে। পাড়ি দিতে হয় ২৮ কিলোমিটার পথ। এটা ইন্দোনেশিয়ার ১২৬টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির প্রধানতম একটি এবং সবচেয়ে সক্রিয়ও বটে। 

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার ৬শ’ ফুট উচ্চতার এই আগ্নেয়গিরি যুগজাকার্তা এবং সেন্ট্রাল জাভার মধ্যবর্তী  স্থানে।

সকাল সকাল রওনা হই আমরা।

আমরা বলতে সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোস্টের সাংবাদিক দামার হারসানতো। সাগরকে পেছনে ফেলে উত্তরের পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু করি। তবে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার গিয়েই থেমে যেতে হয়। বাকি পথ আর বিলাশবহুল গাড়িতে যাওয়া যাবে না। স্থানীয়দের চালিত জিপ ভাড়া করতে হবে। কারণ পাথরের আঁকাবাকা রাস্তায় স্থানীয় অভিজ্ঞ চালক না হলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

আমাদের চালক নিনাই। এখানকার লাভা ট্যুরের গাড়িগুলো বিশেষ ধরনের। ঠিক যেন ১৯৪২ সালে এই ভূখন্ডে জাপানের কাছে আত্মসমর্পনের সময় ডাচদের ফেলে যাওয়া যুদ্ধে ব্যাবহৃত গাড়ি। তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই বোঝা গেলো এই ধরনের জিপ ছাড়া আগ্নেয়গিরির কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কারণ এখানে যে কোনো পিচঢালা পথ নেই। বরং পাথর জমে থাকা এবড়ো থেবড়ে পথকে পাত্তা না দিয়ে চলতে হয় গাড়িকে।
জ্বলন্ত মেরাপি আগ্নেয়গিরির উপত্যকায়হারিয়ে যাওয়া এক দুনিয়ার স্বাক্ষী এই আগ্নেয়গিরির উপত্যকা। যত উপরে উঠতে থাকলাম দুপাশে পোড়া স্থাপনার সংখ্যা চোখে পড়তে লাগলো।

২০১০ সালের অক্টোবরের শুরু থেকেই আগ্নেয়গিরি রহস্যময় হয়ে ওঠে। থেমে থেমে ভূকম্পন অনুভূত হতে থাকে। দুই তিন দিন পরপরই আগ্নেয়গিরি থেকে জ্বলন্ত লাভা উপচে বেরিয়ে আসতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে উপত্যকা ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে বলা হয়। দিন যত যেতে থাকে আগ্নেয়গিরি ততো অগ্নিরূপ ধারন করে। ভূগর্ভ নেড়ে ওঠে, আগ্নেয়গিরির মুখ উপচে লাভা বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ২৩ আর ২৪ অক্টোবর আগ্নেয়গিরি ঘিরে ভূমিকম্প হয় ৫০০ বারের বেশি। আগ্নেয়গিরির লাভা গলে ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকায়। বেশিরভাগ গ্রামবাসী এলাকা ছেড়ে গেলেও ঘর পাহাড়া দেয়ার জন্য অনেকেই থেকে যান। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান ৩৫৪ জন গ্রামবাসী। গৃহপালিত পশুগুলোর শরীর থেকে খসে পড়ে চামড়া। পুড়ে যায় ঘর বাড়ি, ব্যক্তিগত বাহনসহ সবকিছু।

গ্রাম থেকে ছোট কমিউনিটি গ্রুপকে বলা হয় হেমলেট। পেটং হেমলেটে এক ব্যক্তি নিজের পুড়ে যাওয়া বাড়ি আর পোড়া দৈনন্দিন জিনিসপত্রকে সাঁজিয়ে গড়ে তুলেছেন জাদুঘর। দর্শণার্থীরা সেখানে ঘুরে ২০১০ সালে আগ্নেয়গিরির উদগীরনের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেন।

জ্বলন্ত মেরাপি আগ্নেয়গিরির উপত্যকায়আগ্নেয়গিরির লাভার সঙ্গে গড়িয়ে আসা পাথরগুলো কালো রংয়ের। তাই এখানকার সব স্থাপনাগুলোই কালো রংয়ের। শেষ কবে লাভা উদগীরিত হয়েছে? দামার বললো, এইতো ২০১৪ এর মার্চ- এপ্রিল মাসে। পা যেন অবশ হয়ে আসতে চাইলো। ৪ লাখ বছরের পুরনো শিলাবেষ্টিত এই আগ্নেয়গিরিকে দৈত্য মনে হচ্ছিলো। তবে দেয়ালে লেখা, 'যা ঘটে তা ঈশ্বরই ভাল জানেন। '
পরের গন্তব্যে যেতে যেতে কোমড়ের হাঁড়গুলো যেন এপাশ ওপাশ হয়ে গেলো।  

দামার জানালো, ২০১০ এর পূর্বে এখানে রাস্তা ছিল। ভূমিকম্প আর লাভা উদগীরনের প্রভাবে এই পথ এখন ভেঙ্গে চুরমার। আরো উপরে উঠলাম। এখানকার মাটি পাথর সবই ছাই রংয়ের। কয়েকশো মিটার নিচে একটি ফাঁকা স্থান থেকে ছাই কুড়োচ্ছে কয়েকশো লোক। তবে এই ফাঁকা স্থান যে নদী তা দামার না বললে বোঝা অসম্ভব। এই নদীতে কোনো কালেই পানি ছিল না। লাভা বয়ে যায় এই নদী দিয়ে। এরপর ঠান্ডা হলে সেই লাভার বালুগুলো উত্তোলন করেন স্থানীয়রা। এটা অবৈধ হলেও অধিক মুনাফার কারণে দুস্কৃতিকারীদের ঠেকানো যায় না।

এই স্থানে এক বিশালাকৃতির দৈত্যাকার পাথর খণ্ড। কোনো এক কালে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে এই পাথরখণ্ড ছুড়ে এখানে এসে পড়ে। একে শয়তানের প্রতিকৃতি বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
জ্বলন্ত মেরাপি আগ্নেয়গিরির উপত্যকায়মনে প্রাণে খাঁটি জাভানিজ দামার হারসানতো বলেন, জাভানিজ সভ্যতা গড়ে উঠেছে এই আগ্নেয়গিরিকে ঘিরেই। এই আগ্নেয়গিরি যেমন প্রাণ কেড়ে নেয় তেমনি এর কারণেই এখানকার মাটি খুব উর্বর।

তিনি জানান, সাধারণত প্রতি ২ থেকে ৩ বছর পরপর ছোট ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে আর ১৫ থেকে ১৬ বছর পর বড় ধরনের লাভার উদগীরণ ঘটে। আর ভূমিকম্প নৈমত্তিক ঘটনা।

২০১০ সালের সেই ভয়াবহ উদগীরণের পর সরকার থেকে সকলকেই এই স্থান ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে। তবে স্থানীয়রা এ নির্দেশ মানতে ইচ্ছুক নয়। শুধু ৩৫৪ টি প্রাণ নয় প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ সেই লাভার বিস্ফোরণে বিকলাঙ্গ হয়েছে বলে জানালেন দামার।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৭
এমএন/বিএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

সিঙ্গাপুর এর সর্বশেষ