ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

খেলা

‘আমি মুখিয়ে ছিলাম, সুযোগ পেলে শুধরে ভালো করার’

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২১
‘আমি মুখিয়ে ছিলাম, সুযোগ পেলে শুধরে ভালো করার’

নির্বাচকরা বলেছেন, টেস্টের কথা ভেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে রাখা হয়নি। তিনি নিজেও নাকি বিশ্রাম চেয়েছিলেন।

বুধবার (১৭ নভেম্বর) মিরপুরে অনুশীলনের পর মুশফিকুর রহিম সাফ জানিয়ে দেন, এর কোনোটাই নয়, বাদ পড়েছেন তিনি। জাতীয় দলের জ্যেষ্ঠতম ক্রিকেটার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন। এ সময় তিনি  সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে উত্তরও দেন।  

প্রশ্ন: পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে আপনার না থাকাকে কীভাবে নিচ্ছেন? নির্বাচকদের ব্যাখ্যা তো নিশ্চয় শুনেছেন।

মুশফিক: ক্রিকেটার হিসেবে উত্থান-পতন থাকবেই ক্যারিয়ারে। আর এটাই তো প্রথমবার নয়। হ্যাঁ, অনেক দিন পর বাদ পড়লাম। আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। বিশ্বকাপে নিজের কাছে আমার যে প্রত্যাশা ছিল, সে অনুযায়ী খেলতে পারিনি। এই কারণেই যদি বাদ দিয়ে থাকে, ক্রিকেটার হিসেবে আমি ভালোভাবেই নিচ্ছি। দিনশেষে আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।

প্রশ্ন: শোনা যাচ্ছিল আপনি নাকি নিজে থেকেই বিশ্রাম চেয়েছিলেন?

মুশফিক: নাহ, এখনো আমি ওই পর্যায়ে যাইনি যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কাউকে বলতে হবে। আমি মুখিয়ে ছিলাম, এই তিনটি টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেলে চেষ্টা করতাম বিশ্বকাপে করা ভুল শুধরে নেওয়ার এবং ভালো করার। বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ যে দুটি সিরিজ জিতেছে, সেই মোমেন্টাম যেন আবার ফিরিয়ে আনতে পারি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি হয়নি। তবে দলের সবার জন্য শুভ কামনা।

প্রশ্ন: একটা বিশ্বকাপ দিয়ে কাউকে বিচার করা কতটা যৌক্তিক, বিশেষ করে ধারাবাহিকতার জন্য দীর্ঘদিন যাঁর প্রশংসা হয়েছে? আপনার কথা বলছি।

মুশফিক: বিশ্বকাপ অবশ্যই অনেক বড় ইভেন্ট। বড় ইভেন্টে কেউ ভালো করে, কেউ খারাপ করবে। ভারতের মতো দল সেমিফাইনাল খেলবে না, কেউ ভাবতেও পারেনি। সত্যি বলতে, নিজের প্রত্যাশা পূরণ না হলেও আমি যতগুলো বিশ্বকাপ খেলেছি, এবারই সবচেয়ে ভালো খেলেছি। যেকোনো সময় অনেক ক্রিকেটার এসব কারণে বাদ পড়েন। আমি তাদের মধ্যে একজন। এই তো। সমস্যা নেই, আমার কাছে এটা নেতিবাচক মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যেভাবে চেষ্টা করেছি সব সময়, এখনো সেভাবেই করছি। একটা ব্যর্থতাই দুনিয়ার শেষ নয়। আমার কাছে মনে হয়, সামনে সুযোগ এলে আমি চেষ্টা করব।

প্রশ্ন: নির্বাচকরা বা টিম ম্যানেজমেন্ট কি বিষয়টি নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?

মুশফিক: নাহ, সেভাবে কথা হয়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই সিরিজে আমি অ্যাভেইলেবল কি না। আমি বলেছি, ‘অবশ্যই’। দলে নেওয়া বা না-নেওয়া তো আমার হাতে নেই। তাঁরা মনে করেছেন, টি-টোয়েন্টি দলে আমার হয়তো ওরকম প্রয়োজন নেই। এটা ঠিক আছে। পরে নান্নু ভাই (প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন) বলেছেন যে, তাঁরা এই সিরিজে আমাকে বিশ্রাম দিচ্ছেন, কারণ সামনে অনেক খেলা আছে টেস্টে। তবে বাংলাদেশে এমন কোনো ক্রিকেটার সম্ভবত নেই যে বলতে পারে, পর পর চারটি টেস্ট খেলতে পারবেই। আমি তাই জানি না, কী যুক্তিতে (বিশ্রাম)। অবশ্যই যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য প্রস্তুতি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। হয়তো তাঁরা ওভাবেই চিন্তা করেছেন। গতবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে যেহেতু দল অনেক খারাপ করেছে, এবার হয়তো তারা চ্যাম্পিয়ন হতে চায় বা এক-দুইয়ে থাকার জন্য লড়াই করতে চায়। হয়তো এ জন্য বাদ দিয়েছে।

প্রশ্ন: আপনি নিজে বারবার বলছেন আপনাকে ‘বাদ’ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নির্বাচকরা বলেছেন, ‘বিশ্রাম’।

মুশফিক: আমি মনে করি সত্যিকারের সৎ ও সত্যি ভাবনাটাই বলা উচিত। দলের আগে, দেশের আগে তো কেউ না। সেখানে আমি তো নগণ্যতম একজন সদস্য। পারফরম্যান্সে ওঠা-নামা থাকবে এবং একজন ক্রিকেটারকে অবশ্যই পারফরম্যান্স ও ফিটনেস দিয়ে বিচার করবেন। সেটা পরিষ্কার করে বললেই হতো যে, ‘আমরা অন্য রকম চিন্তা করছি, এই সিরিজে না, সামনে যদি পারফরম করে আসতে পারো’, যেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর কি। এই ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করে বললে আমার কাছেও অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করত যে তাঁরা আমাকে এতটুকু হলেও সম্মান করেছেন। যদি সামনের চারটি টেস্ট ম্যাচের (পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) কথাই সত্যি ভেবে থাকেন, তাহলে বিশ্বকাপের আগেও বলতে পারতেন যে, ‘সামনে এই টেস্টগুলো আছে, টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে তুমি বিরতি নিতে পারো’, তাহলে হয়তো আরো উপযুক্ত হতো, মানসিকভাবে তৈরি থাকতাম। আমি নিজেও হয়তো সেভাবে পরিকল্পনা করতাম যে বিশ্বকাপ থেকে ফিরে জাতীয় লিগে একটি-দুটি ম্যাচ খেলতাম। আমাকে এত দেরিতে জানিয়েছে যে (টেস্টের) প্রস্তুতির সেরকম কিছু পাচ্ছি না।

একটু খোলামেলা কথা বললে ভালো হয়। তাঁরা যদি আমাকে বলতেন যে ‘আমরা এ রকম চিন্তা করছি’, তাহলে আরেকটু প্রস্তুতি নিতে পারতাম (টেস্টের জন্য)। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে অ্যাভেইলেবল কি না, এরপর হুট করে (বিশ্রাম)। তখনো যদি তাঁরা বলতেন যে বাইরে রাখার চিন্তা করছেন, তাহলে অন্যভাবে পরিকল্পনা করতে পারতাম। কিন্তু সব কিছু শেষে হুট করেই বলা হলো, প্রস্তুতি নেওয়া এখন কঠিন।

প্রশ্ন: দল ঘোষণার পর প্রধান নির্বাচক বলেছেন এটা নতুন পথচলা। একজন সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর এই মন্তব্যে বিশেষ কোনো বার্তা পাচ্ছেন?

মুশফিক: আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছি। টেস্ট-ওয়ানডের তুলনায় টি-টোয়েন্টিতে আমি নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারিনি। মাঝেমধ্যে কয়েকটা ইনিংস বা সিরিজ হয়তো ভালো খেলেছি, কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে আরো অনেক ধারাবাহিক হওয়ার জায়গা আমার আছে। এটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।

আমি পারফরম করতে না পারলে অন্য কেউ আসবে, এটা স্বাভাবিক। যদি পারফরম্যান্সই কারণ হয় (বাইরে রাখার), তাহলে সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সামনে বিপিএল আছে, এরপর আরো খেলা আছে, আগামী বছর বিশ্বকাপ... আমি জোর দিয়েই চেষ্টা করব টি-টোয়েন্টি সেট আপে আবার ফিরতে। নির্বাচক-টিম ম্যানেজমেন্টের চিন্তা তো আমার কাছে কেউ কিছু বলেনি এখনো। আমার ভাবনায় থাকবে পারফরম্যান্স দিয়েই দলে ফেরা।

প্রশ্ন: নির্বাচকদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বললেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগেও যোগাযোগের ঘাটতির কারণে আপনি খেলতে পারেননি। অনেক সময়ই শোনা যায় যে, আপনাকে তারা অনেক কিছু বলতে সংকোচ করেন!

মুশফিক: আমি কি খাঁচার বাঘ যে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, এখন আমি তাঁদের বা অন্যদের খেয়ে ফেলব (হাসি)? আমার অভিষেক হয়েছে সুমন ভাইয়ের (নির্বাচক ও সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার) অধিনায়কত্বে। এখন উনি যদি বলতে না পারেন ছোট ভাইকে কোনো কথা... শুধু উনি কেন, আকরাম ভাই, নান্নু ভাই, উনারা বিকেএসপিতে খেলতে গিয়েছিলেন, আমরা বল থ্রো করেছিলাম, তখন আমাদের জন্য স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। এখন তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারছি। এখানে যদি ওনারা কথা বলতে না পারেন আমার সঙ্গে... আমি তো সব সময়ই ওয়েলকাম করি। কিছু ক্রিকেটার আছে, যাদের অন্যভাবে বলতে হয়। সেটা তো তাদের জানতে হবে। আমারও বুঝতে হবে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে নান্নু ভাই ফোন করে আমার বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিয়েছেন। আমি বলেছিলাম যে উন্নতি হচ্ছে অবস্থার। এর কদিন পর আমি নিজেই নান্নু ভাইকে ফোন করে বলেছি যে, মা-বাবার অবস্থা ভালো এখন, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি (অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য)। তার পরও ওনারা আমাকে কিছু বলতে না পারলে আমার দিক থেকে কিছু করার নেই। আমাকে ছাড়াই তো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জিতেছে। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন যে আমাকে দলে হয়তো আর দরকারও নেই।

প্রশ্ন: কোচিং স্টাফের সঙ্গেও কি সেই যোগাযোগে ঘাটতি আছে? আপনি কতটা স্বচ্ছন্দ কোচিং স্টাফের সঙ্গে?

মুশফিক: আমার জন্য সত্যি বলতে একটু চ্যালেঞ্জিংই। আগেও অনেকবার নানা ঘটনা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, কমিউনিকেশন গ্যাপের সমস্যা আছে। জানি না, আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক! খোলামেলাভাবে সব কিছু বললে, আমার জন্য ভালো হয়, দলের জন্য ভালো হয়। সবার জন্যই ভালো। এমন তো নয় এটা আমার দল! এটা দল ও দেশের ব্যাপার। টেবিলে আলোচনায় বসলে কথা হবে, তর্ক-বিতর্ক হবে যুক্তি দিয়ে। এটাই তো উচিত। একটা উদাহরণ দিই। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে চার নম্বরে আমার রেকর্ড দুর্দান্ত ছিল। হুট করে একদিন চন্দিকা হাতুরাসিংহে বললেন, ‘বিশ্বকাপে তোমাকে ছয় নম্বরে খেলতে হবে। ’ আমি তখন মেনে নিতে পারিনি শুরুতে। বললাম, ‘তুমি আমার গত তিন-চার বছরের পারফরম্যান্স জানো চার নম্বরে?’ তিনি বললেন, সব জানেন। তিনি তখন আমাকে খুব ভালোভাবে সব বুঝিয়ে বললেন যে কেন ছয়ে আমাকে দরকার। যুক্তি, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এরপর আমরা একমত হয়েছি। নিজেই পরে বলেছি, ‘এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত। দলের জন্য খুশি মনেই করব। ’ আমি খেললাম ছয়ে। ভালো খেললাম। চারে রিয়াদ ভাই খেললেন, ভালো করলেন। দলের লাভ হলো। এভাবেই তো হওয়া উচিত আলোচনা। এখন কেউ যদি বলে, ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, দলের দরকার। ’ আর কিছু নেই। ওই ক্রিকেটার কিছু জানে না, কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড জানা নেই, কারণ জানে না, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানে না, তাহলে তো তা অন্য রকম হয়ে গেল। এসব আরেকটু পরিষ্কার করে বলা দরকার।

প্রশ্ন: নিউজিল্যান্ড সিরিজের আগে যখন আপনাকে ও সোহানকে দুই ম্যাচ করে কিপিং করানোর কথা বললেন কোচ, তখনো কি যোগাযোগের ঘাটতি ছিল?

মুশফিক: সেটাই বললাম যে আমাকে বললেই তো হয়! আমি তো জানি যে আমি এখন শেষের দিকে। আমি তো আরো ১৫-২০ বছর খেলব না! যে কয়টা দিনই খেলি, আমার একটা প্রস্তুতি ছিল যে যখন ছাড়ব, আমার জায়গায় যে আসবে, সে যেন আমার চেয়েও আরো পোক্ত ও প্রস্তুত হয়ে আসে। আমি নিজেকে এখন সব সময় শুধু ক্রিকেটারই ভাবি না, মনে করি যে এই দলে মেন্টরও হতে পারি। আমি তাই নিশ্চিত করে চাই, যেখানে আমি শেষ করব, সেখান থেকে যেন ওরা শুরু করতে পারে। এটা আমার দায়িত্ব।

সোহানের কথা বলি... দলের পরিবেশ যদি অন্য রকম হয়ে যায়, ছেলেটা আমার দিকে তাকাতে সংকোচ করছে, আমারও ওর দিকে তাকাতে খারাপ লাগছে। এটাই স্বাভাবিক। এ জন্যই বলছি যে, এই ব্যাপারগুলো আরেকটু মসৃণভাবে করতে পারত। আমাকে বললেই হতো। আমার এমনিতেই পরিকল্পনা ছিল, বিশ্বকাপের পর ছেড়ে দিতে পারি (কিপিং)। আমার চেয়ে ওর (সোহান) সামর্থ্য বেশি এখানে। আমিই এটা করতে পারতাম। নিজে ওর হাতে (গ্লাভস) তুলে দিতে পারতাম। কেন সেটা হলো না, এটা তো আসলে জানি না।

অবশ্য নতুন কিছু না। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-রিয়াদ যাঁর কথাই বলেন, এটা নতুন কিছু না!

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২১
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।