ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তারার ফুল

নাট্য-পর্যালোচনা

নতুন রূপে পুরাতন ‘কবি’

শুভাশিস সিনহা (অতিথি লেখক) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৪
নতুন রূপে পুরাতন ‘কবি’ দৃশ্য: ‘কবি’

ইউসুফ হাসান অর্কের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নামের নৃত্যগীতাভিনয়-সমৃদ্ধ এক প্রযোজনার একাডেমিক অংশীদার ছিলাম ছাত্র হিসেবে। পরবর্তীকালে মৎরচিত ‘ডালিমকুমার’-এর রূপায়নকারীও তিনি।



তাই আবেগ, উৎকন্ঠা নিয়ে ‘কবি’ দেখতে গিয়েছিলাম, তারাশংকরের উপন্যাস ‘কবি’ সমকালের এক তরুণ ইউসুফের নাট্য ‘কবি’তে রূপবদলের চমক-গমকগুলো দেখার শিল্পবাসনায়।

যথারীতি বাদ্য-গীত-নৃত্য নিয়ে পালা পরিবেশনার বঙ্গীয় রীতিকে কায়েম করা হলো। চার তরুণীর আকস্মিক নৃত্যপ্রবেশ চমৎকার। গায়েন নিজেকে কবিতে চরিত্রান্তরের বয়ান করলেন। শুরু হলো নাটক। নির্দেশক নিজে ‘কবি’র পাঠবদলের কাজটি বেশ মুন্সিয়ানার সাথে করেছেন। সরলরৈখিক পরম্পরাকে মাঝেমধ্যেই ভেঙে সূত্রধারের সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন উল্লম্ব ঘটনার ফুল। ফলে আখ্যান ‘কবি’ ভাঙা-চোরা নানান উপাখ্যানের দৃশ্যমালা পরে নিয়েছে। সে-মালার পুষ্পশোভায় নানান রঙ-গন্ধ তো আছেই।

এতসব আয়োজনের দাপটে আখ্যানের সেই গল্প, মানুষ, ঘটনার আবেদন কি হারিয়ে যাবে? এমন আশংকা শুরুতে খানিকটা উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু নির্দেশক বিষয়ীকে বিষয়ের ওপর চড়ে বসতে দেননি। মাঝে মধ্যে দু’য়ের খানিকটা দ্ব›দ্ব হলেও, পরক্ষণেই তা সমঝোতা-বোঝাপড়ায় নিষ্পত্তি হয়েছে। যে শ্রেণীবিপন্ন মানুষ নিয়ত অন্তরের কামনা ও আকাক্সক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে কবিয়াল থেকে একদিন কবি হয়ে ওঠে, শেষাবধি তার অশ্রæ আর রক্তক্ষরণের স্রোতেই নতুন করে প্রবাহিত হয়েছে আমাদের প্রাচীন হৃদয়।

বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই গেল। এই রীতিকে প্রকৃতভাবে বোঝার এবং মেনে-মনে নেয়ার জন্য তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের একটা মোকাবেলা হওয়া জরুরি। আমরা সেই মোকাবেলায় না গিয়ে অনুকরণ বা অনুসরণে থেকে যাচ্ছি কিনা। কোনো একটি ক্রিয়া মঞ্চে ঘটার সময় তাকে বিবৃত করার আঙ্গিকটা অনেক সময়ই ডাবল-স্ট্যান্ডার্ড মনে হয়। কিন্তু চরিত্রের সংলাপের যৌক্তিকতা ও যথানুগতার শর্তসীমার বাইরে দূরগামি এবং অন্তর্গত আরও কোনো ভাবকে যখন তৃতীয়জন বা থার্ড পারসনকে দিয়ে (কিংবা প্রথম বা দ্বিতীয় পুরুষেরই তৃতীয় রূপকে দিয়ে) কৌশলে বিবৃত করা হয়, তখন ঠিকই বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির শক্তি প্রকাশ পায়। ‘কবি’ দেখতে দেখতেও তার দুর্বলতা ও শক্তির যুথপ্রকাশ দেখেছি। তাই অভিনন্দনের পাশাপাশি নির্দেশকের জন্য প্রশ্নের বাঁকা চিহ্নটিও পড়ে রইল।

অভিনেতাদের প্রবেশ-প্রস্থানের মুহুর্মুহু পথ-বদলের খেলা ছাড়াও নির্দেশক হিসেবে ইউসুফ হাসান অর্কের অন্যতম ক্ষমতা সংগীত-পরিকল্পনা ও গ্রন্থনায়, আবারো তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সুরের খেলা ও লীলা দুটোই ছিল ‘কবি’তে।   মাঝে-মধ্যে মনে করিয়ে দেয় এস এম সোলায়মানের কথা। যদিও সোলায়মান সংগীতকে আরও বেশি নাটকীয় করতেন। সংগীতই প্রধান পারফরম্যান্সে পরিণত হয়ে যেত তার প্রযোজনায়। থিয়েটারের গান-গাওয়ার ব্যাকরণটাকে মনানী ইসলাম কনক সুন্দর রপ্ত করেছেন।

অভিনেতারা অতি-পেশল অভিনয়ের অধুনা-রীতির দিকে খুব একটা যাননি, গীতল আখ্যানের রস-গ্রহণে রক্তমাংসের অধিক-আন্দোলন অন্তরকে কোথাও প্রতিবিদীর্ণ করতে পারে- এই ভয় থেকে হয়তো বা। তারপরও দেখেছি চরিত্র বা ঘটনার অতল ছোঁয়ার মরিয়া প্রয়াস। সে-প্রয়াসে বয়স ও অভিজ্ঞতাগত সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই হয়তো সফল হননি, তবু কাঁচা সবুজ ধানশীষের আলোড়ন যেন আগামী নবান্নে পেঁকে উঠার ইশারা।

অভিনয়ে চোখ-মুখের অভিব্যক্তির প্রকাশ বেশ ভালো ছিল। তুলনায় সংলাপ প্রক্ষেপণের স্পষ্টতা-মধুরতা-ব্যঞ্জনার দিকে নজর খানিকটা কম ছিল বলা যায়। আলোর ব্যবহার পরিমিত, যথাযথ। মঞ্চের ডাউন থেকে আপে তিনটি ভাগে আলোর মঞ্চ-এলাকাবদল দৃষ্টিমধুর ছিল। পোশাক প্রথানুগ, আড়ম্বরহীন।

‘কবি’ রূপায়নের শরীরী প্রকাশে সানী ঘোষ প্রায়ই আনত ছিলেন। বাংলার কবিয়ালের জীবন আনত। কিন্তু যে-মঞ্চে গীত হয়, যে-মঞ্চের সে রাজা, তার ওপর দাঁড়িয়ে আনত থাকার দরকার নেই। তবু সানী কবিকে যথেষ্টই ধারণ করতে পেরেছেন। ঠাকুরঝি চরিত্রে সায়মা সিরাজী স্বর্ণার প্রেমকাতরতার প্রকাশ ছিল চমৎকার; তবে ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও সামাজিক অনিশ্চয়তাবোধের আশংকা আরও পরিণতভাবে আনার চেষ্টা করতে হবে। বসনের ভূমিকায় চেতনা রহমানের গেটআপ, দৃষ্টি-অভিব্যক্তি আকর্ষক, তুলনায় বাচিক অভিনয়ের পরিশীলন খানিকটা প্রয়োজন মনে হলো। ঝুমুর দলের মাসী ফারজানা জলিকে মনে থাকবে অনেকদিন।

এর আগে চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্যসম্প্রদায়ের ‘কবি’ দেখেছিলাম। সেই ‘কবি’ খানিকটা শিথিল ছিল, তার বয়ানগত নাট্যআয়োজন ছিল আয়তনে প্রয়োজনের একটু বেশি ; কিন্তু নিখাদ মূলানুগামি সেই নাট্যকর্মও অভিনয়ের মোটমাট-পরিণত শক্তিতে উপভোগ্য হয়েছে। অনেক টেকনিক বা মেকানিজম রপ্ত করার পর অভিনয়ের সাবলিমিটির যে চ‚ড়ান্ত জায়গা, অভিনেতার আরাধ্য সেই তীর্থস্থানই।

আমাদের একাডেমিক থিয়েটারের তরুণ নাট্যতুর্কিদের অশ্ব নিশ্চয় সেই পথেই ধাবিত হবে। এই আকাক্সক্ষা রইলো। সব মিলিয়ে একটি অসাধারণ প্রযোজনার জন্য নির্দেশক, অভিনেতা, কলাকুশলী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগকে অভিনন্দন জানাই।  

বাংলাদেশ সময় : ১৯২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ