ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তারার ফুল

ফাহমিদা নবীর স্মৃতিতে বাবা মাহমুদুন্নবী-

‘অন্যায় আচরণ তাকে আহত করেছিলো’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
‘অন্যায় আচরণ তাকে আহত করেছিলো’ মাহমুদুন্নবী ও ফাহমিদা নবী

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী মাহমুদুন্নবীর জন্মবার্ষিকী আজ ১৬ ডিসেম্বর। তার অনেক কালজয়ী গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

নবীন-প্রবীন সব মানুষের প্রিয় এই শিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তারই যোগ্য কন্যা কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী। ফেসবুকে বাবাকে নিয়ে ফাহমিদার লেখাটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

কিংবদন্তি শিল্পী মাহমুদুন্নবী বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানের খাতায় এক অবিনাশী স্বরলিপি, যার গান ১৯৬১ সাল থেকে বর্তমান তারুণ্য পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রোতার মুখে মুখে এক অনবদ্য প্রেরণা , ভালবাসা, ভালো লাগার এক দুর্বার অনুভূতি । জন্ম ১৯৪০ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর , বর্ধমান এর আসানসোলে নানা বাড়িতে । এরপর বেড়ে ওঠা দাদার বাড়ী কেতু গ্রামে । দেশ বিভাগের পর আমার দাদা বজলুল করিমের চাকরির সুবাদে চলে আসেন তৎকালীন পূবর্ পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ।
খুব ছোটবেলায় মাত্র ৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন গান পাগল এই মানুষটি । মা হারা ছেলেটি কিন্তু ছোটবেলায় গান শুনিয়ে সবার আদর খুঁজে নিতেন ...। খেতে খুব পছন্দ করতেন.... চকলেট ,বাদাম খেতে ইচ্ছে হলো, গান শুনিয়ে দিলেই হতো… সব হাজির হয়ে যেতো...। আখের গুড়ের ফেনা আব্বার খুব পছন্দ ছিলো !

...আব্বা ছোটবেলায় খুব ডানপিটে আর দূরন্ত স্বভাবের ছিলেন । ঘুড়ি ওড়ানো আর বল খেলা আব্বার খুব প্রিয় ছিল । বাড়ি থেকে বই হাতে বেড়িয়ে আব্বা সোজা মাঠে চলে যেতেন । এছাড়া পাড়ার কোনো গাছে কোনো পাকা ফল থাকতে পারতো না আব্বার জন্য । শৈশব থেকে গান গাওয়া আর খেলা আব্বার প্রিয় ছিল । গান গাইলে আর বল খেললে সবাই খুব ভালোবাসে এই বোধটা আব্বার ভেতরে খুব কাজ করতো....! একদিন কলেজের শিক্ষক বললেন, ‘তুই একদিন অনেক বড় শিল্পী হবি...কিন্তু বল খেললে গানের গলা তো নষ্ট হয়ে যাবে ...!’ সেই থেকে আব্বা বল খেলা ছেড়ে দিলেন ...! সে সময়ে ফরিদপুরে গানের শিক্ষক ছিলেন প্রাণবন্ধু সাহা । তাঁর কাছে প্রথম গানের তালিম নেয়া শুরু করেন । এছাড়া কলকাতা রেডিওতে অনুরোধের আসরে যে গানগুলো হতো , সেগুলোও শুনতেন আর গলা ছেড়ে গাইতেন নিয়মিতভাবে ।

এভাবেই গান শিখতে গিয়ে টের পেলেন কলেজের পরীক্ষার আর অল্প দিন বাকি ..! তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পালিয়ে যাবেন ....! গানই তাঁকে ভীষণভাবে টানছে ..! এরপর আব্বা গান গাইবার পূর্ণ বাসনায় প্রথমে চট্টগ্রাম গেলেন এবং সেখান থেকে ঢাকায় গেলেন । ঢাকায় তাঁর দেখা হয় ওস্তাদ গঁফুর খাঁ-এর সাথে । তিনি আব্বার গান শুনে মুগ্ধ হন । তখন আব্বা তাঁর কাছে গান শেখা শুরু করেন । পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে আব্বা শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন । এসময় একদিন কার্জন হলে গান গাইতে গিয়ে পরিচয় হয় বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী শেখ লুৎফর রহমানের সাথে । তিনি করাচীতে থাকতেন , ঢাকায় এসেছিলেন, সেখানে আব্বার গান শুনে মুগ্ধ হন তিনি । সে সুযোগে আব্বা করাচী রেডিওতে তাঁর গান করার ইচ্ছার কথা তাঁকে জানান এবংআমার দাদাকে অনেক বুঝিয়ে তাঁর কাছ থেকে তিনশ টাকা নিয়ে চললেন করাচী । সঙ্গীতের আরেক ধাপ শুরু হলো তখন থেকেই । দুইশ বিশ টাকা প্লেনের টিকেট কেটে আব্বা রওনা হলেন করাচী । সেখানে গিয়ে করাচী কালচারাল সেন্টারে গান গেয়ে বাঙালি মহলে বিশিষ্ট শিল্পী হয়ে ওঠেন তিনি । সেই থেকে শুরু ।

করাচী এসে প্রথম গান গাইলেন ‘জিনে ভি দো’ ছবিতে । এরপর একে একে তিনি গান করেন যেসব ছবিতে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পিয়াসা’, ‘উলঝান’ । এছাড়া তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান পরিবেশন করতে শুরু করেন । কিন্ত সব কিছুর পরও নিজের দেশে ফিরে বাংলায় গান করার তাগিদ অনূভব করতে থাকলেন তিনি । সেই তাগিদেই এক সময় দেশে ফিরে এলেন তিনি । ঢাকায় ফিরেই তিনি রেডিও তে প্রথম নিজের লেখা সুরে গান করেন ‘কাকনের ঠিনিঠিনি নূপূরের রিনিঝিনি’ গানটি । সময়টা ছিল ১৯৬০ সাল । তখন নিয়মিত ঢাকা রেডিওতে আব্বার গান শ্রোতা সংখ্যা বাড়াতে শুরু করল এবং সিনেমা রেডিও টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান পরিবেশন আব্বাকে ভীষণ ব্যস্ত করে তুললো । যে কারণে আব্বা এক সময় চাকরিও ছেড়ে দিলেন ।

ইতিমধ্যেই বিয়ে করেন দিনাজপুরে খালাতো বোন রাশিদা চৌধুরীকে....সেসময়ই তিনি গাইলেন, ‘আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন’, ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো’ , ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘তুমি যে আমার কবিতা’ ... আরো কতো ছবির গান...যে গানগুলো আজো আব্বার প্রিয় মুখটি আব্বার সেই গায়কি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় । সেই সময় সুরকারদের লক্ষ্যই ছিল ছায়াছবির সবচেয়ে রোমান্টিক গানটিই গাওয়াতে হবে মাহমুদুন্নবীকে দিয়ে । তা না হলে ছবি জনপ্রিয় হবেনা । নায়করাজ রাজ্জাক আর মাহমুদুন্নবী যেন একই বৃন্তে দুই ফুল । যার ফলশ্রুতিতে “স্বরলিপি” ছবির প্রত্যেকটি গানই ছিল মাহমুদুন্নবীর কন্ঠে এবং প্রত্যেকটি গান শ্রোতামহলে ব্যাপক সমাদৃত হয় । সে সময় থেকে অনেক পুরষ্কার তিনি পেতে শুরু করেন ।

আব্বার লেখার হাত খুব ভালো ছিল । উপন্যাস থেকে রম্যরচনা সব ধরনের লেখা তিনি লিখেছেন । সেসময় “খবর ”পত্রিকায় আব্বার লেখা প্রকাশিত হয় । ‘আর পারিনা’ নামে একটি রম্য রচনাও আব্বা লিখেছেন যা সেসময় প্রকাশিত হয় এবং সমাদৃত হয়...।

পরবর্তীতে ১৯৬৯ এ গণঅভ্যুথানের সময় এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বাড়াতে অনেক গণজাগরণমূলক গান নিজেই লিখেন এবং সুর করেন এবং গানও গান তিনি । স্বাধীনতার পরে আব্বা প্রচুর আধুনিক গান করেন । তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গানগুলোর উল্লেখযোগ্য ছায়াছবির নাম হলো – ‘কাগজের নৌকা’, ‘বেহুলা’, ‘আবির্ভাব’, ‘স্বরলিপি’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘নাচের পুতুল’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, ‘আলো তুমি আলেয়া’, ‘দি রেইন’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘অনির্বাণ’, ‘আধুরি দস্তান’, ‘পিয়াসা’, ‘উলঝান’, ‘জিনা ভি মুশকিল’, ‘মধুমিতা’, ‘হীরা’, ‘হারজিৎ’ আরো অনেক । ছবির গানের পাশাপাশি নিজের গান যেমন করেন তেমনি অন্যদের জন্য গানও করেন । এ সময় আব্বা আধুনিক গানে কিছুটা পাশ্চাত্য ধারা এবং ক্লাসিক্যাল ধারা নিয়ে আসেন ।

আব্বা একটা সময়ে ‘আধুনিক সংগীত নিকেতন’ নামে একটা সংগীত স্কুল করেন ,যেখানে তাঁর সংগীত অনুরাগীরা তাঁর কাছে গান শিখতো । তাঁর সেসব ছাত্র আজো তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে ।
আব্বা সব সময় খুব হাসিখুশি প্রাণখোলা এক মানুষ ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন একা কিছু করা যায় না । তাই সব সময় নিজের গানের পাশাপাশি অন্যদের গান করতেন । সে কারণে আমাদের বাড়িতে সব সময় প্রচুর শিল্পীর আনাগোনা ছিল । তাঁদেরকে আব্বা গান এর ব্যাপারে সব রকম পরামর্শ দিতেন । শিল্পী বা যে কোনো মানুষকে সহযোগিতা করা ছিল আব্বা/শিল্পী মাহমুদুন্নবীর স্বভাব । এই স্বভাবটি তাঁর জীবনের বিশেষ এক সফলতা মনে করি... আমরা তাঁর সন্তানরা সেই সরল জীবন আর সংগীতের ভুবনের বাসিন্দা হয়ে তাকেই অনুসরণ করতে চেষ্টা করছি......!

ইতিমধ্যে সরকারি সফরে আব্বা বিভিন্ন দেশে গান করতে যান । ১৯৭৬ সালে ‘দি রেইন’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পান ‘আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই’ গানটির জন্য । দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে , জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পাবার পর থেকে কোনো এক অজানা কারণে ধীরে ধীরে তাঁর কন্ঠকে অনেক গানে ব্যবহার করা কমিয়ে দেয়া হলো । বাংলা আধুনিক গানে এত অবদান যে মানুষটির, তাঁর ক্ষেত্রে এ ধরনের অন্যায় আচরণ তাঁকে যথেষ্ট আহত এবং হতাশ করেছিল যে কারণে তিনি অনেকটাই অভিমানী হয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন । খুব ইচ্ছা ছিলো ক্যাসেটে গান রেকর্ড করবেন... কিন্তু হলো না...! ১৯৯০ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র ৫৪ বছর বয়সে বাংলা আধুনিক গানের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাহমুদুন্নবী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন । আজ তাঁর জন্মলগ্নে আমরা তাঁকে পরম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি ।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
এসও

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ