ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তারার ফুল

আমি, আপনি, আমরা সবাই ডিক্যাপ্রিও!

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬
আমি, আপনি, আমরা সবাই ডিক্যাপ্রিও! ছবি: সোলায়মান হারুনী মৃদুল/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ধরুন আপনি ১৮২০ শতকে কোনো এক ভয়ানক বনে আছেন। আপনার পেশা পশম শিকার করা।

একদিন ছাইরঙা হিংস্র এক ভালুক আপনার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো। প্রাণে বাঁচতে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত কি লড়াইয়ের মানসিকতা থাকবে? মৃত্যুর মুখে পড়ে নিস্তেজ দেহে ওই ভাল্লুককে কি পরাস্ত করতে পারবেন? কিংবদন্তি অভিযাত্রী হিউ গ্লাস পেরেছিলেন। জীবন বাঁচানোর সেই সংগ্রাম নিয়ে অস্কারজয়ী মেক্সিকান নির্মাতা আলেহান্ড্রো গঞ্জালেজ ইনারিতু পরিচালনা করেছেন ‘দ্য রেভেন্যান্ট’।

অস্কারে একডজন মনোনয়ন পাওয়ায় সারাবিশ্বে এ ছবি নিয়ে এখন যতো কৌতূহল। তাই এটি ঢাকায় নিয়ে এসেছে স্টার সিনেপ্লেক্সে। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির এই প্রেক্ষাগৃহে বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত হয়ে ছবিটির বিশেষ প্রদর্শনী দেখলাম। ‘রেভেন্যান্ট’ শব্দের অর্থ মৃত্যুর মুখ থেকে কোনো ব্যক্তির ফেরা। ছবিটির গল্প যতো এগোচ্ছিলো, ততোই মনে পড়েছে কবীর সুমনের গান- ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’।

একটা মানুষ মরতে মরতেও কোনোরকম বেঁচে যাওয়ার পর কীভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, সেই আশা আর সংগ্রামের নাম ‘দ্য রেভেন্যান্ট’। এখানে আছে হিংসা, হিংস্রতা, ঈর্ষা, নৃশংসতা, অমানবিকতা, ক্লান্তি, দুঃসময়...। শেষ পর্যন্ত সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় বুকে বেঁধে রাখা আশা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ও অমানবিকতার সঙ্গে যুদ্ধে সব হারিয়েও নিঃস্ব মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প ‘দ্য রেভেন্যান্ট’।

ছবির শুরুতে রয়েছে তিনজন মানুষের পরম স্বস্তি নিয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকা। এই দৃশ্য পরে গোটা ছবির যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে। ভালুকের থাবায় মুমূর্ষু হয়ে যাওয়া গ্লাসকে বয়ে নিয়ে চলা দুঃসাধ্য ছিলো অভিযাত্রী দলের। তাই দলনেতার নির্দেশে তিনজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তার দেখভালের জন্য। বাকিরা এগোতে থাকে। তিনজনের মধ্যে হক হলো গ্লাসের পুত্র। বাকি দু’জনের একজন নিষ্ঠুর ও বিকৃতমস্তিষ্কের মানুষ জন ফিৎজেরাল্ড। এ কারণে সে গ্লাসকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। হক বাঁচাতে এলে তাকে মেরে ফেলে জন। এরপর বাকি সঙ্গীকে নিয়ে গ্লাসকে ফেলে চলে যায় সে।  

প্রত্যন্ত জনমানবহীন হিমশীতল পরিবেশে গ্লাস এরপর বাঁচলো কীভাবে? মৃত্যুর দুয়ারে যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে তার এই বেঁচে ফিরে আসার গল্প অবিশ্বাস্য লাগে। অথচ সত্যি! পুত্রশোকে কাতর নিঃসঙ্গ গ্লাস বরফাচ্ছাদিত পথে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। ভালুকের থাবায় তার পিঠের ক্ষত এতই গভীর যে বাকি শরীরে পচন হয়ে যাচ্ছিলো। এ কারণে মৃত্যুই অবধারিত ছিলো তার জন্য। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। দুর্দশার মধ্যেও বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। সহচরের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্পও তার মনে।

শ্বাপদসঙ্কুল ভয়ানক বনে একজন শিকারীর বেঁচে থাকার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তার সবই করেছিলেন হিউ গ্লাস। একই কাজ করতে হয়েছে ডিক্যাপ্রিওকে। হিউ গ্লাস চরিত্রে তিনি কী অভিনয় করলেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একজন অভিনয়শিল্পী এরকম কাজও দেখাতে পারেন! প্রতিটি দৃশ্যে ‘টাইটানিক’ তারকার আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট। তার মুখে সংলাপ তেমন নেই বললেই চলে। দৃষ্টি আর মুখের অভিব্যক্তি কথা বলেছে তার হয়ে।

চরিত্র এবং গল্পের প্রয়োজনে একজন অভিনেতা কতোটা নিবেদিত হতে পারেন, সেটা হৃদয়স্পর্শীভাবে তুলে ধরেছেন ডিক্যাপ্রিও। চরম প্রতিকূল পরিবেশে হিউ গ্লাস চরিত্রটিকে বাস্তবে রূপ দিতে কম খাটেননি তিনি। তার অভিনয় দেখলে মনে হবে কষ্টটা হচ্ছে আপনারও! এখানে আমি, আপনি, আমরা সবাই হয়ে উঠি ডিক্যাপ্রিও! এটাই তার সাফল্য।

বন্য হিংস্র প্রাণীর করাল থাবায় জর্জরিত হওয়ার মুহূর্তগুলোকে ফুটিয়ে তোলা, প্রায় মরে যাওয়া মানুষের মতো নড়তে না পারার অভিব্যক্তি দেখানো, দাঁড়াতে সক্ষম না হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলা, বরফ-শীতল নদীতে ঝাঁপ দেওয়া, নদীতে মাছ ধরে কাঁচা খেয়ে ফেলা, বুনো মহিষের মাংস কাঁচা খেয়ে ফেলা, হাড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচতে মৃত ঘোড়ার শরীর থেকে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ঘোড়ার ভেতর নগ্ন হয়ে ঢুকে আশ্রয় নেওয়া- সবকিছুই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে ডিক্যাপ্রিওর স্মরণীয় অভিনয় গুণে। দর্শকদের কারও কারও মুখে শোনাও গেলো, ‘এই ভদ্রলোক এবার অস্কার পাবেনই!’

৮৮তম অস্কার সেরা অভিনেতার মনোনীতদের তালিকায় এগিয়ে আছেন ডিক্যাপ্রিও। আগে কয়েকবার মনোনয়ন পেলেও এবার হয়তো আর শুন্য হাতে ফিরতে হবে না তাকে। ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ দেখলে বারবার একথাই মনে হবে। এ ছবি মূলত তার ওপরই দাঁড়িয়ে। তাকে বাদ দিলে ছবিটাই হতো না! দর্শকের সব মনোযোগ একাই ধরে রেখেছেন তিনি। আড়াই ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস যাত্রায় তিনিই কেন্দ্রবিন্দুতে।

সতেরো শতকের অ্যাডভেঞ্চারধর্মী কাহিনী নিয়ে মাইকেল পুনকের ‘দ্য রেভেন্যান্ট : এ নোবেল অব রিভেঞ্জ’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ছবিটি। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকার জন্য মানুষ সংগ্রাম করে যায়, এটাই মানুষের প্রকৃতিগত। ছবিটির মূল বক্তব্য এমনই। ইনারিতু যা বানান তা-ই বিখ্যাত হয়ে যায়। গত বছর তার ‘বার্ডম্যান’ অস্কারে সেরা হয়েছিলো। তিনিই হয়েছেন সেরা পরিচালক। এবারের অস্কারেও তার হাতে সেরা পরিচালকের সম্মান উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্য ‘দ্য রেভেন্যান্ট’-এর বেশ কয়েকটি দৃশ্যে কিংবদন্তি রুশ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কির হুবহু ছায়া রয়েছে। এ নিয়ে ইউটিউবে একটি ভিডিও এসেছে।

‘দ্য রেভেন্যান্ট’ আরেকজনের জন্য এতো দৃষ্টিনন্দন। তার নাম ইমানুয়েলে লুবেজকি। তিনিই এ ছবির চিত্রগ্রাহক। আহা কি চোখ জুড়ানো সব দৃশ্য! প্রাকৃতিক আলো ব্যবহারের জন্যই এমন মনে হতে পারে। আর্জেন্টিনা, কানাডা, আমেরিকা ও মেক্সিকোর বরফাচ্ছাদিত অরণ্য আর হিমশীতল পরিবেশে দৃশ্যধারণ হয়েছে এর। স্টার সিনেপ্লেক্সের আটমস সাউন্ড ছবিটিকে আরও বেশি জীবন্ত করেছে। সময় থাকলে বড় পর্দায় ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে দেখতে পারেন।

* ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবির ট্রেলার :


* ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবিতে তারকোভস্কির ছায়া :


বাংলাদেশ সময় : ১৯২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৬
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ