ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

দিনাজপুরের পথে প্রান্তরে

ফরিদ ফারাবী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৪
দিনাজপুরের পথে প্রান্তরে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দেশের আনাচে কানাচে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেও উত্তরবঙ্গ খুব একটা ঘোরা হয়নি। তাই যখন হঠাৎ করেই নওগাঁ বন্ধু দোলনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।

কয়েক দিন ঘুরে বেড়ালাম নওগাঁ-নাটোর-রাজশাহী। অতঃপর রংপুরের বন্ধুদের আমন্ত্রণে রাজশাহী থেকে একাই রওনা হলাম রংপুর।

রংপুর শহরে পৌঁছতেই সন্ধ্যা হলো। স্থানীয় বন্ধু আমান আর বাপ্পি এসে স্টেশন থেকে রিসিভ করলো। ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে ওদের সাথেই শহর ঘুরে বেড়ালাম। ওরাই জানতে চাইলো কোথায় কোথায় যেতে চাই। কান্তজীর মন্দিরের কথা শুনে তখনই পরিকল্পনা হলো পরদিন কান্তজীর মন্দিরে যাওয়ার।
pho_1
সকালে উঠেই সব প্রস্তুতি সেরে জাহাজ কোম্পানির মোড়ে মিলিত হলাম সবাই। এর মধ্যেই আমাদের সাথে যোগ দিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মৌ। মেডিকেল মোড় বাস স্টেশনে এসে সবাই একসাথে নাস্তা সারলাম। দিনাজপুরের বাসের টিকিট কাটা হলো। রংপুর থেকে দিনাজপুর যাওয়ার পথেই পড়বে কান্তজীর মন্দির।

বাস ছাড়লো সকাল ৯টায়। পথের দু’পাশে ফসলি জমিতে চোখে পড়ল তামাক ক্ষেত। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে এখনো তামাক চাষাবাদ হয় এই অঞ্চলে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই রংপুরের ভিন্নজগত, নীলফামারী, সৈয়দপুর ছেড়ে কান্তজীর মন্দির মোড় এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে ভ্যান নিয়ে সরাসরি মন্দিরের গেটে। আশপাশে বিস্তীর্ন মাঠ। প্রতি বছর এই এলাকা জুড়ে আয়োজন করা হয় বিশাল মেলার। মন্দিরের গেট পেরিয়ে প্রবেশ করলাম মন্দির এলাকায়। সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৫০ ফুট উঁচু বিশাল কান্তজীর মন্দির।
pho_2
ভ্রমণার্থীদের জন্য বলে রাখি কান্তজীর মন্দির দেশের সবচাইতে ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো মন্দিরগুলোর একটি। প্রতিবছর সনাতনধর্মী অসংখ্য পূন্যার্থী আসেন এই মন্দিরে। এছাড়া পর্যটকদের ভিড় তো রয়েছেই।

মন্দিরের নির্মাণশৈলী ও টেরাকোটা একে করেছে অনন্য। টেরাকোটাগুলো যুগ যুগ ধরে বহন করে আসছে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন ইতিহাস। পোড়ামাটির ফলকে আ‍ঁকা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী ছাড়া ও শ্রীকৃষ্ণের ছবি। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটা রয়েছে।
pho_3
জানা যায়, ১৭০০ শতকের শুরুর দিকে দিনাজপুরের তৎকালীন মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তার মৃত্যুর পর পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ মন্দিরের কাজ শেষ করেন।

নিরাপত্তার স্বার্থে মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ খারাপ না হলেও আরো ভালো হতে পারতো। আশপাশের এলাকা নিয়ে আরো আকর্ষণীয় জায়গা হতে পারতো।
pho_4
যাহোক আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা শেষে ছবি তোলা হলো মন্দিরের। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে যদিও পরিকল্পনা মোতাবেক রংপুর ফিরে যাওয়ার কথা তবু পরিকল্পনা বদলে দিনাজপুর রাজবাড়ি ও রামসাগর দেখেই ফেরার সিদ্ধান্ত হলো। তাই প্রধান সড়কে এসে দিনাজপুর শহরের বাসে উঠলাম সবাই।

দিনাজপুর শহর থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ২০ কি.মি.। আধা ঘণ্টা লাগলো শহরে পৌঁছতে। সেখান থেকে কাছেই দিনাজপুর রাজবাড়ি। দিনাজপুরের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জায়গাগুলোর একটা এই রাজবাড়ি। প্রায় ৩০০ বছরের বেশি এই রাজবাড়ির বয়স। একসময় বেশ জৌলুশ থাকলেও এখন আর  আগের অবস্থা নেই।

জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৫২ সালে তৎকালীন সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করলে দিনাজপুরের সর্বশেষ মহারাজা জগদীশ নাথ রাজবাড়ি ছেড়ে সপরিবারে কলকাতা চলে যান। তখন থেকেই এই রাজবাড়ি পরে আছে এই অবস্থায়।
pho_5
মন্দিরে ঢুকতেই চোখে পড়বে চমৎকার সিংহমূর্তি বসানো সিংহদ্বার। ভিতরের এলাকা বেশি বড় না হলেও বেশ ভালো। চারপাশে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। তেমন কোনো সংরক্ষণের উদ্যোগও নেই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম রাজবাড়ি এলাকা।

পাশেই রাজবাড়ির মন্দির। পূজা চলছিলো মন্দির প্রাঙ্গণে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে মন্দির সংরক্ষণে নিয়োজিত কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। হাতে সময় কম তাই আর দেরি না করে রওনা হলাম রামসাগরের পথে।

রাজবাড়ি থেকে রামসাগর খুব বেশি দূরে না হলেও রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ।
pho_6
ব্যাটারি চালিত অটোতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগলো রামসাগর পৌঁছতে। টিকিট কেটে ঢুকলাম রামসাগর এলাকায়। বেশ বড়সর এলাকা। রামসাগরও বিশাল। রামসাগরের সঙ্গে বরিশালের দূর্গাসাগরের বেশ মিল রয়েছে। তবে দূর্গাসাগর আকারে আরো ছোট।

জানা যায়, ১৭৫০ সালের দিকে রাজা রামনাথ এই দিঘী খনন করেন। কথিত আছে সে সময় বৃষ্টির অভাবে খরায় এ এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাজা রামনাথ বহু মানুষ নিয়োগ করে এই দিঘী খনন করেন। কিন্তু দিঘী খননের পরও পানি উঠলো না। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ অনুয়ারী রাজা নেমে পড়েন দিঘীতে। দিঘী পানিতে ভরে উঠলো রাজার প্রাণের বিনিময়ে। রাজার নামেই নামকরণ করা হল দিঘীর। পুরো দিঘীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৪০০ ফিট এবং প্রস্থ প্রায় ১০০০ ফিট।
pho_7
দীঘির আশাপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম সবাই। বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট ও একটি শিশু পার্কও রয়েছে এখানে। সবাই মিলে হাসি ঠাট্টায় ভালোই সময় কাটলো।

বিকেল হয়ে আসছে। যেহেতু আজই ঢাকা ফেরার কথা সেজন্য একটু আগেভাগেই রংপুর ফিরতে হবে। তাই দিনাজপুরকে বিদায় জানিয়ে সবাই রওয়ানা হলাম রংপুরের পথে। সেদিন যদিও আর ঢাকা ফেরা হয়নি,স্মৃতিময় রংপুরকে বিদায় জানিয়ে পরেরদিন ছুটলাম ব্যস্ত ঢাকার পথে। তবে পুরো ট্যুরে বন্ধুদের আতিথেয়তা জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
pho_8
কিভাবে যাবেন
ভ্রমণার্থীরা যারা ঢাকা থেকে দিনাজপুর যেতে চান তারা কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে নাবিল, হানিফ অথবা শ্যামলী পরিবহনের গাড়িতে করে রওয়ানা হতে পারেন। বাস ভাড়া পড়বে ৬০০-৬৫০ টাকা। এছাড়া কমলাপুর থেকে দ্রুতযান ও একতা এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেনও ছেড়ে যায় দিনাজপুরের উদ্দেশে।  

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
pho_9
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন/



বাংলাদেশ সময়:  ১০৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।