ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

শীতের দিনে স্বপ্নের কাশ্মীর

মো. শাহজাহান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৪
শীতের দিনে স্বপ্নের কাশ্মীর

ছেলে বেলা থেকে বুকে লালন করে আসছি পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর দেখার। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে আজ যৌবনে।

দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার অভিপ্রায়ে বুড়ো বন্ধু খোরশেদ আলম মাদবর খসরু, আফ্রিকা মহাদেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা হান্নান ভাই এবং মনো মামু-এই তিন সফর সঙ্গী নিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে কাশ্মীর ঘুরতে গেলাম তাও আবার শীতে।

কাশ্মীর
জম্মু-কাশ্মীর ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়ি জনপদ। যার আয়তন ২,২২,২৩৬ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা ১,০১,৪৩,০০০ জন প্রায়। শতকরা ৭৭ ভাগ লোক শিক্ষিত।

কাশ্মীরি, ডুগরি ও লাদাখি এদের প্রধান ভাষা। জাফরান, গম, আপেল, ধান ও বার্লি কৃষিজ ফসল। কার্পেট, শাল ও ওলেন কাপড়ের জন্য স্থানটি বিখ্যাত।

জম্মু-কাশ্মীরের শীতকালনী রাজধানী জম্মু ও গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর। শ্রীনগরে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসে। কাশ্মীরে ডাল লেক, চরচিনার, শংকর চূড়া, ভিসনোদেবী মন্দির, লাদাখ, হযরত বাল মসজিদ, শালিমারবাগ, লেহ, শোনমার্গ, গুলমার্গ, পহেলাগাঁও, নিশাতবাগ, চশমাশাহী, নাগীনলেক, লালচক, অমরনাথ মন্দির, জিলাম নদী প্রভৃতি পর্যটক আকৃষ্ট স্থান। কাশ্মীর বেড়ানোর উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর-জানুয়ারি, এপ্রিল-জুলাই এবং সেপ্টেম্বর- অক্টোবর।

ডাল লেক
কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর শহরের নিকটবর্তী একটি বিখ্যাত ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা পাহাড়ের পাদদেশে ডাললেকের অবস্থান। লেকটি ৩ কিলোমিটার প্রস্থ ও ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ। বলতে গেলে নৈঃসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

পাহাড় বেষ্টিত ডাললেকের রূপ আপনাকে মুগ্ধ করবে। শীতকালে আশপাশের পাহাড়গুলো যেন সাদা আর সাদা। দু’চোখে যেদিকে তাকাবেন সেদিকে শুধু বরফে ঢাকা পাহাড় অথবা সিকারা ভাসা ডাল লেক চোখে পড়বে।

লেকে ভাসমান সিকারা, হাউজবোট, দোকান, হোটেল আপনাকে অজানা জগতে নিয়ে যাবে। লেকের পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। লেকের পাড়ে বিশাল আকৃতির চিনার ও পাইন গাছ এখানকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

শীতকালে লেকে প্রচুর অতিথি পাখি দেখতে পাওয়া যায়। প্রচণ্ড শীতে আপনি কাবু হয়ে যাবেন। তবে ভয়ের কিছু নেই। রাতে ঘুম হবে আরামের। প্রত্যেক হোটেলেই রুম হিটার/ বেড হিটার আছে। খাওয়া দাওয়া খুবই স্বাদের। মানুষগুলো খুবই সুন্দর। এখানে শীতকাল পর্যটকশূন্য থাকে। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শীতকালে কাশ্মীর বেড়ানোর কি যে মজা! কী যে আনন্দ! তা একবার ঘুরে আসলে বুঝতে পারবেন।

হযরত বাল মসজিদ
শ্রীনগর শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ডাল লেকের উত্তর পার্শ্বে লেকের তীরে হযরত বাল মসজিদ অবস্থিত। সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আরবীয় ডিজাইনে তৈরি করা মসজিদ। মুসলমানদের জন্য এই মসজিদটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ১৬৩০ সালে মদিনা থেকে হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাথার চুল এনে মসজিদে একটি বিশেষ গ্লাসে রাখা হয়েছে। ধর্মীয় বিশেষ বিশেষ দিনে মাথার চুল ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের দেখানো হয়। মসজিদটি কঠোর নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা থাকে।

মসজিদের আশপাশে অসংখ্য জালালি কবুতরের আবাস। মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর। মসজিদের চারপাশ শীতকালে বরফাবৃত থাকে।

শালিমার বাগ
শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে শালিমার বাগ অবস্থিত। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী নুরজাহানের জন্য এটি তৈরি করেন। বাগানটি ৫৩৯ মি. দৈর্ঘ্য এবং ১৮২ মি. প্রস্থ। বাগানের মধ্যে ঝর্না ধারা, নানান প্রজাতির ফুলগাছ, ফল গাছ। বিশাল আকৃতির চিনার ও পাইন গাছের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। দেখতে খুব চমৎকার লাগে। পুরো বাগান শীতকালে বরফে আচ্ছন্ন থাকে। বসন্তকালে বাগানটি ফুলে ফুলে ভরা।

চশমা শাহী
চশমা শাহী বাগানের অপর নাম শাহীবাগ। শ্রীনগর থেকে ৯ কি. মি. দূরে। মোঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজের জন্য চশমাশাহীবাগ নির্মাণ করেছিলেন। বাগানটি ১৬৩২ সালে নির্মাণ করা হয়। বসন্তকালে বাগানে ঠাণ্ডা পানি পাওয়া যায়।

পহেল গ্রাম
শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ৯৬ কি. মি. দূরে এবং সমতল ভূমি থেকে ২১৯৬ মিটার উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় পহেলগাঁও বা পহেল গ্রাম অবিস্থত। শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁও যাওয়ার পথের প্রাকৃতিক দ‍ৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। বিশাল বিশাল পাইনগাছ, চিনারগাছ, বরফে ঢাকা জাফরান খেত, ফসলের জমি আর রাস্তা ঘাট বরফের চাদরে মোড়া। দূরের পাহাড়গুলো ধবধবে সাদা। পাহাড়ি ঝর্না ধারা পাথর বেয়ে বেয়ে ঐতিহাসিক জিলাম নদীতে আছড়ে পড়ে। কখনও বা পাহাড়। কখনও বা নদী। কখনও বা বড় বড় পাথর। পাহাড়ি বন। বৃক্ষ রাজিতে ঝুলে থাকা বরফ। আঁকা আঁকা পাহাড়ি পথ। কখনও বা গাড়ি পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা। আবার সমতল ভূমিতে দূরের পথ পাড়ি দেওয়া। যেতে যেতে একটু পরেই দেখা মিলবে একটি গ্রাম-নাম তার পহেলগাঁও।

কী সুন্দর! চমৎকার !
কী আনন্দ! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। অপরূপা। রূপসি। শীতকালে এখানের মানুষগুলো শীতকাবু হয়ে যায়। শীত থেকে বাঁচার জন্য শীতের বিশেষ পোশাক পরতে হয়।

রিস্তা নামের বিশেষ এক ধরনের মজাদার খাবার পাওয়া যায়। স্থানীয়রা গ্রামটিকে সুইজারল্যান্ডের সাথে তুলনা করে থাকে। পহেলগাঁও দেখলে নাকি সুইজারল্যান্ড দেখা হয়ে যায়। বিশেষ বিশেষ পাহাড়, সমভূমি, গভীর বনাঞ্চল, শীতল আবহাওয়া ইত্যাদি কারণে স্থানটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে।

গুলমার্গ
শ্রীনগর শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে আজব পাহাড়ের চূড়ায় গুলমার্গ অবস্থিত। এটা সমতল ভূমি থেকে ২ হাজার ৭৩০ মিটার উঁচুতে।

এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুলের সমারোহ। শতকালে যেদিকে তাকাবেন শুধু বরফ আর বরফ। অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতি তার সব রূপ এখানে ঢেলে দিয়েছে। বড্ড বেশি সুন্দর। কী যে ভালো লাগা! কতো যে ভালোবাসা। সার্থক জীবন। অফুরন্ত আনন্দ। শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ যাওয়ার পথের দৃশ্যই আপনার ভ্রমণ পিয়াসী মন কানায় কানায় ভরে যাবে। ঘর, বাড়ি, গাছ-পালা, ফসলের জমি সব কিছুই বরফের নিচে শীতকালে ঢাকা পড়বে। বৃক্ষরাজি পাতাশূন্য।

মনে হবে প্রকৃতির সব কিছুই এখানে মৃত। আপেল বাগান যেন আগুনে পুড়ে গেছে। ঘরের চালে, বাগানে- চিনার গাছে বরফ ঝুলে থাকবে। এখানকার মানুষগুলোও প্রকৃতির মতো সুন্দর। গুলমার্গ দেখলেই বুঝতে পারবেন কাশ্মীরকে কেন ভূ-স্বর্গ বলা হয়।

গাড়ি দিয়ে পাহাড় বেয়ে বেয়ে গুলমার্গ যাওয়ার পথের দৃশ্য এবং ভালো লাগার অনুভূতি আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। স্কেটিং, রোপওয়ে দিয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে আসা-যাওয়া, বরফে গড়াগড়ির সুযোগ রয়েছে।


কোথায় থাকবেন
শ্রীনগরে অসংখ্য হোটেল ও কটেজ রয়েছে। হোটেল ও কটেজগুলো ভারি সুন্দর ডিজাইনে তৈরি। শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রিতে নেমে আসে। তাই যে হোটেলে রুম হিটার বা বেড হিটার আছে এ রকম হোটেল বা কটেজে ওঠতে হবে। তবে রাতে আরামে ঘুমনো যাবে। লাল চকে অবস্থিত হোটেল তৈমুরকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

কীভাবে যাবেন
কলকাতার হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন থেকে সুপার ফাস্ট ট্রেনে জম্মু অথবা রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনে দিল্লী এবং দিল্লী থেকে জম্মু যেতে হবে। জম্মু রেলওয়ে স্টেশনের নিকট কেটে ট্যুরিস্ট বাস বা জিপে করে শ্রীনগর যাওয়া যাবে। অথবা আকাশ পথে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে থেকে বিমানে শ্রীনগর যেতে পারবেন। বেশির ভাগ বিমান দিল্লী হয়ে শ্রীনগর যাবে।


সতর্কতা
শীতকালে কাশ্মীরের তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রিতে নেমে আসে। শীতের পোশাক সাথে নিতে হবে। কাশ্মীরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পাবেন আপনি। তবে ধোকাবাজদের থেকে সাবধান।

শ্রীনগর পৃথিবী বিখ্যাত এক পর্যটন এলাকা। খাবার নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হবে না এখানে আপনাকে। ভাত, রুটি, ড্রিংকস সবই পাবেন এখানে।

লেখক: শাহজাহান মাস্টার
শিক্ষক, শ্রীপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পর্যটক সমিতি

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন/



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।