ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মুম্বাই-কলকাতার কড়চা-১৪

‘তুরাগ’ মার্কা স্পাইস জেটে পানি ফ্রি!

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫
‘তুরাগ’ মার্কা স্পাইস জেটে পানি ফ্রি! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মুম্বাই থেকে ফিরে: ভালো খবর নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দে দিনভর টুক-টাক কেনাকাটা সেরে নিলাম। তখনও ‍আসলে জানি না ফেরার টিকিট কনফার্ম কিনা।

রাতে খবর এলো ট্রেনের টিকিট কিছুতেই মিলছে না। তারপর জানলাম পরের দিন সন্ধ্যায় তিনটি টিকিট মিলেছে, তাতেই যেতে হবে চারজন। তাও আবার মুম্বাই দুরন্ত নয়, জ্ঞানেশ্বরীতে। সময় লাগবে ৩২ ঘণ্টার মতো। তবু রাজি হলাম।

হোটেলে দুপুর ১২টা পেরুলেই গুণতে হবে আরও চার হাজার রুপি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সকালে উঠে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়বো মুম্বাইয়ের অদেখা জায়গাগুলো দেখতে। তাই হলো। প্রথম গন্তব্য ছিলো শহরের একেবারে উত্তরপ্রান্তে গড়ে ওঠা ফিল্ম সিটি। হ্যাপা শুরু সেখান থেকেই। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গিয়ে জানলাম বিদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য শুধু রোববার বরাদ্দ। সেদিন ছিলো শনিবার। অনেক অনুরোধ করেও ঢোকা গেলো না।

মন খারাপ করে সামনে থেকে কয়েকটি ছবি তুলে উঠে বসলাম ক্যাবে। আপা বললেন, ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে মুম্বাই এলাম আর টাটা মেমোরিয়াল দেখবো না! সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিলাম আরও ১৫ কিলোমিটার দূরে টাটায়। সেখান থেকে ঘুরলাম মালাবার হিল, পেডার রোডসহ কয়েকটি স্থান। এখানে আবার দেখা হলো বিখ্যাত জ্যাসলক হসপিটালসহ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির বাড়ি।

ঘুরতে ঘুরতে এলাম পশ্চিম মুম্বাইয়ের বান্দ্রার কাছে অবস্থিত লোকমান্য তিলক রেলওয়ে টার্মিনাসে। ভাবলাম খাওয়া-দাওয়া সেখানেই সেরে ফেলবো। কিন্তু এসে টিকিটের কথা শুনে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। জানলাম টিকিটের জন্য আমরা ওয়েটিংয়ে ছিলাম, সেখান থেকে একটি মাত্র কনফার্ম হয়েছে। জনপ্রতি প্রায় তিন হাজার রুপি ভাড়া গুণলেও যেতে হবে এক সিটে। সঙ্গে রোগী আছে। তার ওপর জার্নি করতে হবে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। তাই সাহস হলো না। স্টেশনে নানাভাবে চেষ্টা করেও লাভ হলো না।

হোটেল ভাড়া বাঁচানোর জন্য সারাদিন ট্যাক্সি ঘুরে ভাড়া দিয়েছিলাম ১৫শ রুপি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আমাদের আবার ফিরতে হলো সেই ভিল পারলের হোটেল ক্রজ রয়েলে। এর মধ্যে কলকাতায় নানা জনে নানাভাবে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হলো। বাংলাদেশ থেকে টাকাও পাঠাতে হলো বাড়তি ৬০ হাজারের মতো। মিলবে মিলবে করে আরও দুদিন কেটে গেলো। তবু পেলাম না আরাধ্য ট্রেনের টিকিট।

বিড়ম্বনা কিছুতেই পিছু ছাড়ছিলো না। সহায় ছিলো না ভাগ্যও। মনের দুঃখে অবশ্য ঘরে বসে থাকি নি এই দুদিন, ঘুরেছি আরও জায়াগায়। ট্রেনের চিন্তা ছেড়ে এবার চেষ্টা করতে লাগলাম প্লেনের। কিন্তু সেখানেও টিকিট নেই পছন্দমতো সময়ে। ভাড়াও গুণতে হবে জনপ্রতি প্রায় তিনগুণ।

অনেক ভাবনা-চিন্তার পর সিদ্ধান্ত হলো প্লেনেই যাবো। জনপ্রতি সাড়ে ৮ হাজার রুপিতে টিকিট মিললো স্পাইস জেটের। এরজন্য থাকতে হবে আরও একদিন। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম আগে থেকে টিকিট করে না রাখার ভুল কত বড়। পরে শুনেছি এই ভুল ট্যুরিস্টরা প্রায় সবাই করেন।

মুম্বাইয়ের জল-হাওয়া কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ছিলো না আমাদের। অবশ্য এই জল-হাওয়া-খাবারে কারও বিরক্ত, অভক্তি হওয়ারও সুযোগ নেই।

আমাদের ফ্লাইট ছিলো রাত সাড়ে ৮টায়। বিকেলেই রওয়ানা দিলাম ভিল পারলের প‍াশেই অবস্থিত ছত্রপতি শিবাজি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে। আমাদের মধ্যে তানজিল আগে প্লেনে ওঠেনি। তাই ওর উত্তেজন্য একটু বেশি ছিলো। বোর্ডিংয়ের সময় পড়লাম আরেক বিপদে। আমরা ছুরি, কিছু প্রসাধনী কিনেছিলাম। জানলাম ছুরি নেওয়া যাবে না, আর প্রসাধনীর নির্দিষ্ট মাপ রয়েছে। সব ঢোকানো হলো আপার ল্যাগেজে। কিছু হাতে।

ফাইনাল চেকিংয়ে ধরা খেলো হাতের প্রসাধনীগুলো। অবশ্য ওখানকার চেকারের সহৃদ্যতায় সে যাত্রা পার পাওয়া গেলো। টিকিট ছাড়া মুম্বাইয়ের সবকিছু বলা যায় হয়ে থাকলো সুখকর।

যাইহোক প্লেনে উঠে দেখলাম প্রতি সারিতে তিনটি করে আসন। মাঝে অল্প একটু জায়গা চলাচলের জন্য। সিটগুলো এতো চাপা যে একটু স্বাস্থ্যবান আর লম্বা মানুষের জন্য বিপদের শেষ নেই। আমরা সবাই রোগা-পাতলা মানুষ। তবু বসে যেন কেমন দম বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো। তারপর আবার যাত্রী ১৮১ জন। খালি নেই একটি আসনও।

প্লেনের ভিতরের অবস্থা এমন হলেও বোর্ডিং থেকে প্লেন পর্যন্ত যাওয়ার গাড়িটি অনেক বেশি বিলাসবহুল ছিলো।

প্লেন চলা শুরুর পর থেকেই মনে হলো যেন ঢাকার রাস্তার তুরাগ কিংম্বা, সুপ্রভাতে চেপেছি। পা পুরোপুরি ছড়ানো যায় না। সিটও বেশি ফোল্ড করা যায় না।

চলাচলের রাস্তায় একজন গেলে আরেকজনের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এসিও এত মানুষের ভিড়ে কাজ করছিলো না ঠিকমতো। রীতিমতো মাথা ব্যথা শুরু হলো। যত ওপরে উঠতে লাগলো আরও বাড়তে থাকলো। যখন ৪০ হাজার ফুট আর সাড়ে ৯শ কিলোমিটার গতিতে চলতে চলতে হঠাৎ নিচে নামছিলো তখনকার অভিজ্ঞতা ছিলো আরও খারাপ। শুধু মনে হচ্ছিলো কখন নামবো। তানজিল অবশ্য এসব তোয়াক্কা না করে বারবার জিপিএসের মাধ্যমে দেখছিলো আমরা কত ফুট উপরে আছি, কত গতিতে চলছে এসব।

এরমধ্যে আবার নতুন ভূত চাপলো টেকনোলজির পণ্ডিত তানজিলের মাথায়। প্লেনে বাথরুম নিয়ে এবার তার আগ্রহ। যথারীতি উঠে গেলো বাথরুমে। বাথরুমে যতগুলো সুইচ আছে সব টিপে দেখতে দেখতে সবশেষে ইমারজেন্সি সুইচে দিলো চাপ। সঙ্গে সঙ্গে হাজির সুন্দরী এয়ারহোস্টেসরা। ‘এনিথিং রং’ তানিজল শুধু মুচকি হেসে ‘নো প্রবলেম’ বলেই চলে এলো।

বাংলাদেশে যতবার প্লেন চড়েছি ২০ মিনিটের রাস্তায়ও মোটামুটি ভালো নাস্তা দিয়েছে। কিন্তু স্পাইস জেটে উঠে দেখলাম পানি চাইলেও ছোট কাপের অর্ধেক দেন আনুশকা শর্মার স্টাইল ধরা সুন্দরী এয়ারহোস্টেস। রাত ১০টার পর পেটে টান ধরলো সবার। অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো কোনো খাবার দেবে। কিন্তু পরে জানা গেলো পানি ছাড়া আর সবই কিনে খেতে হবে।

একটু অবাকই হলাম। সবসময়ই শুনে এসেছি, দেখে এসেছি প্লেনে অল্প হলেও নাস্তা-খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম স্পাইস জেট। পরে ১২০ রুপিতে কাপ নুলডলস আর ৬০ রুপিতে কফি পান করেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। কারণ পকেটের টাকা ততক্ষণে প্রায় সব রেখে দিয়েছে ভালো লাগার আর শেষ তিনদিন কষ্টের অভিজ্ঞতা দেওয়া মুম্বাই শহর।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫
এএ

** মুম্বাইয়ে ঢাকার ‘গাউছিয়া’-‘বসুন্ধরা মল’!
** পাউভাজিতে মাতোয়ারা গোটা মুম্বাই
** মুম্বাই-কলকাতার কড়চা-১১
** চোখের সামনে আম্বানির বিলিয়ন ডলারের বাড়ি!
** ডায়মন্ড ব্যবসায়ীদের মালাবার হিলে ‘ঝুলন্ত উদ্যান’
** এটাই তো বলিউডি মুম্বাই!
** মুম্বাইয়ের ‘বাজু’তে দিনভর ঘোরাঘুরি
** সাগরকোলে হাজি আলী দরগা
** বলিউড তারকাদের বেহাল জুহু বিচ!
** প্রথম দর্শনেই মুম্বাইপ্রেম, চিকিৎসায় মন ভালো
** মনভোলানো খানাপিনায় ২৬ ঘণ্টায় মুম্বাই
** সোনার হরিণ ট্রেন টিকিট, অতঃপর হাওড়া স্টেশন
** ৫৫২ টাকায় ঢাকা থেকে কলকাতা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।