ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ফেব্রুয়ারিতেই আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো

আহসান মঞ্জিলে নতুন রঙ, অন্দরমহলে গ্যালারি হচ্ছে

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
আহসান মঞ্জিলে নতুন রঙ, অন্দরমহলে গ্যালারি হচ্ছে ছবি: নূর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: নতুন রঙ পড়বে আহসান মঞ্জিলের দেয়ালে। ওয়েদার কোট পেইন্টে ফের ঝকঝকে হয়ে উঠবে গোটা ভবনের এধার-ওধার।

ভেতরে-বাইরে রঙ পড়তে শুরু করেছে। বাইরের রঙ একই গোলাপী ধাচের। পর্যটন বছরে পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে আহসান মঞ্জিল হচ্ছে আরো সুসজ্জিত, আরও বড়।

আহসান মঞ্জিল বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কুমারটুলি এলাকায় ঢাকার নওয়াবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির সদর কাচারি। বর্তমানে জাদুঘর।
 
ঢাকার নবাবদের এই বাড়িতে অন্দরমহলের বন্ধ দরজা এবার খুলবে। সে অংশটিকেও তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে জাদুঘরের গ্যালারি হিসেবে। সেখানে অন্দরমহলের নারীদের ব্যবহার্য্ আসবাব-তৈজষপত্র যা কিছু সংরক্ষিত হয়েছে সেগুলো স্থান পাবে।

আগের আদলে নতুন শক্তরূপ পাবে অন্দরমহল থেকে রাজদরবারে যাওয়ার বারান্দা পথটিও। সে লক্ষ্যেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য কাঠের বারান্দা পথটির ঘুলঘুলিতে বাসা পেতেছে চিল। সে নিয়ে ভাবনায় আছেন জাদুঘরের রক্ষকরা। কি আর করা! চিলের বাসাটি ভাঙা পড়বে এই আয়োজনে।

অন্দরমহলে নারীদের আবাসিক অংশ যেমন হওয়া উচিত সেভাবেই সাজানোর কাজ চলছে। সেখানে মোট ১২টি গ্যালারি হবে। এনিয়ে আহসান মঞ্জিলে মোট গ্যালারির সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৫টি।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আওতায়, জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই জাদুঘর এখন অবশ্য তৈরি হচ্ছে বিদেশি অতিথিদের স্বাগত জানানো জন্য। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই এখানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো। সেখানে বাংলার ঐতিহ্য মসলিন আর জামদানির প্রদর্শনী হবে। আসবেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। ওই ফ্যাশন শোটির আয়োজনের কেন্দ্রে থাকছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ও তার স্ত্রী ক্রিস্টিনা ওভারমায়ার।   

ফ্যাশন শো সামনে রেখে একটু ব্যস্ততার সঙ্গেই আহসান মঞ্জিলের দেয়ালে দেয়ালে এখন ঘষাঘষি চলছে।

চার ধরনের রঙের স্যাম্পল দিয়েছেন কন্ট্রাক্টর আবদুল জলিল হাওলাদার। তার মধ্যে যে কোনওটা কর্তৃপক্ষ পছন্দ করলে তা চড়িয়ে দেওয়া হবে আহসান মঞ্জিলের দেয়ালে দেয়ালে। বললেন, ২৮ জানুয়ারির মধ্যেই কাজ শেষ হবে। এরই মধ্যে কয়েক ডজন শ্রমিক কাজ শুরু করেছে। সময়মতো কাজ শেষ করতে আরও শ্রমিক নিয়োগ করবেন।  

ইতিহাস মতে, মুঘল আমলে এখানে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাহর রঙমহল ছিল। পরে তার ছেলে মতিউল্লাহর কাছ থেকে রঙমহলটি ফরাসিরা কিনে নিয়ে বাণিজ্য কুঠি বানায়। তাদের কাছ থেকেই ঢাকার নবাবরা এটি কিনে নেয়।

এরশাদের উদ্যোগে জাদুঘর

এরপর ইতিহাসের পরিক্রমায় নবাবরা সব হারান। ধীরে ধীরে রঙ হারায় রঙমহলও। ভেতরে ঐশ্বর্যময় সম্পদের ছড়াছড়ি নিয়ে বাইরেটা এক পরিত্যক্ত পূতিগন্ধময় পরিস্থিতির মধ্যে পরে। সেখান থেকেই এই মঞ্জিলকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ৮০’র দশকের মাঝামাঝিতে। তৎকালীণ স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের উদ্যোগেই তা হয়।

এজন্য এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা শোনা গেলো আহসান মঞ্জিলে নিয়োজিত এখনকার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুখেই। মূল ফটকের দারোয়ান থেকে শুরু করে ভেতরে তৈজষপত্র সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সকলেই বললেন, এরশাদের অবদানটাই বেশি।

একই কথা জাদুঘরের ২২ ও ২৩ নম্বর গ্যালারির দায়িত্বে থাকা মমিনুল কবিরের। তবে তিনি জানালেন আরও একজনের কথা। তিনি ড. এনামুল হক। জাতীয় জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক, আর বিশ্ব মিউজিয়াম কমিটির চেয়ারম্যান।

মমিনুলের ভাষায়, ড. এনামুল হক সেবার গিয়েছিলেন লন্ডনের একটি মিউজিয়ামে। সেখানে তিনি পেয়ে যান এই নবার পরিবারের একটি অ্যালবাম। তাতেই জানা যায় এই রঙমহলের কোথায় কি রয়েছে তার স্থির চিত্র। ড. এনামুল হক সেই অ্যালবামের একটি কপি দেশে নিয়ে আসেন। তিনিই এরশাদকে বিষয়টিতে উদ্বুদ্ধ করেন। আর ১৯৮৬ সাল থেকেই আহসানমঞ্জিল পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়। আর ১৯৮৮ সালে এটি পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে আর ১৯৯২ সালে জাদুঘর হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়।

প্রথম উদ্যোগটি বঙ্গবন্ধুর

তবে আহসানমঞ্জিলের ভেতরেই পাওয়া গেলো আরেক তথ্য। প্রথম দিকে ঢুকতেই গ্যালারির সামরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ও একটি হাতে লেখা চিঠি। এটি একটি সরকারি নির্দেশনা। যা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের ২ নভেম্বর তারিখে।

এতে বলা হয়েছে- আহসান মঞ্জিলের ঐতিহাসিক মূল্য বিচার করিয়া উহাকে সংরক্ষণ করা সমিচিন বলিয়া মনে করছি। ঢাকা মিউজিয়াম ও পর্যটন কর্পোরেশনের প্রস্তাব দুইটি সমন্বয় করিয়া একটি সাধারণ প্রকল্প তৈরি করা যাইতে পারে যাহার মাধ্যমে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হইতে পারে এবং উহাকে ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত করা যাইতে পারে। উপরোক্ত মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠানের সহিত পুনরায় আলোচনা করিয়া একটি প্রকল্প তৈরি করা যাইতে পারে। ইহার জন্য যে পরিমান অর্থ প্রয়োজন হইবে তাহা হিসাব করত প্রস্তাবটা আমার অবগতি ও অনুমোদনের জন্য পাঠাইতে হইবে। সাক্ষরিত- শেখ মুজিবুর রহমান, ২ নভেম্বর ১৯৭৪।  

এই নির্দেশনা থেকে স্পষ্ট ছিলো আহসান মঞ্জিলকে একটি জাদুঘর ও পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার উদ্যোগ জাতির জনকের ছিলো। তবে এরপর ঘরে নৃশংসতা ও ঘৃণ্য ঘটনার পরম্পরায় সে উদ্যোগ পরে থাকে কেবলই ওই কাগজের নথিতে। ৮০’র দশকের শেষভাগে যা আবার প্রাণ পায়।

শুরুর দিককার একজন কর্মী হিসেবে নিয়োগ পান মমিনুল কবির। তিনি জানালেন, ৫৬ জন কর্মী, ১৬ জন আনসার ও ৪ জন পুলিশ সদস্য এই জাদুঘরে কর্মরত রয়েছেন। এদের অধিকাংশই শুরু থেকে রয়েছেন। অনেকে যোগ দিয়েছেন আরও পরে।

তবে জনবল যতটুকু রয়েছে তা যথেষ্ট নয় বলে মত দেন আবু বকর সিদ্দিক। তিনি প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। বললেন, জনবল এখন অনেক কম। যারা রয়েছেন তাদের অনেকেরই বয়স হয়ে গেছে। মাত্র দুই জন ঝাড়ুদার নিযুক্ত রয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। এছাড়া মালি পদেও রয়েছেন মাত্র দুই জন। অথচ ৪.৯ একর সীমানার এই জাদুঘরের সামনে ফুল ফোটানো আর ভেতর বাহির পরিষ্কার রাখার জন্য এই সংখ্য খুবই সামান্য।

আহসান মঞ্জিলে দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আবুবকর জানান, আগে শুক্রবারগুলোতে দর্শনার্থী হতো দুই তিন হাজার এখন যা ছয় সাত হাজার হয়। কোনও কোনও দিন আট-দশ হাজারও ছাড়িয়ে যায়। তারা ভেতরটা নোংরা করে। অনেকে নিয়ম মানতে চায় না। ভেতরে খাবার নেওয়া বারণ থাকলেও নিয়ে আসে আর প্যাকেট ফেলে রাখে। এতে নোংরা হতেই থাকে। ডাস্টবিন দেওয়া থাকলেও তাতে না ফেলে যেখানে খায় সেখানেই ময়লা ফেলে।

দিনশেষে এগুলো পরিষ্কার করতে দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যায়, দুজন ঝাড়ুদার দুজনই বয়ষ্ক, ফলে তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত ঝাড়ুদার নিয়োগ দেওয়ার আহ্বান কর্মীদের সবারই।

তবে আহসান মঞ্জিলকে আরও বেশি বেশি পর্যটক বান্ধব করে তুলতে আরও অনেক কাজ বাকি রয়েছে বলে মনে করেন তারা। সকলেই বলেন, এর চারিদিকটা সুরক্ষিত করে নোংরা ঘিঞ্জি পরিবেশ দূর করতে পারলে তবেই এটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

মবিনুল ইসলাম বলেন, এখানে সারাদিন হাজার হাজার মানুষ আসে। তারা ভেতরে ঢুকলে একটা মোটামুটি সুন্দর পরিবেশ পাচ্ছেন কিন্তু বাইরের অংশটি অনেক একেবারেই নোংরা। বিশেষ করে আহসানমঞ্জিলের সকল সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় সামনের নদীর তীরে ফলের বাজারের কারণে। সেখানে ময়লা আবর্জনায় পুতিগন্ধময় পরিবেশ সারাক্ষণের। আর নদীর যে ঘাট এই স্থাপনারই অংশ তা এখন ঢাকা পড়েছে ময়লার স্তুপে।  

মূল ফটকে কর্তব্যরত দিণেশ বলেন, এখানে দর্শনার্থীদের পৌঁছাই কষ্টকর। পুরান ঢাকার সরু সড়কপথ ধরে তাদের আসতে হয়। তিনি জানালেন, আরেকটি তথ্য, প্রকল্পটি গ্রহণের সময় আহসান মঞ্জিলের সামনে থেকে যাওয়া সড়কটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত করে সোজা গুলিস্তানের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার একটি প্রস্তাব ছিলো। যা আর আলোর মুখ দেখেনি।

বিদেশি দর্শনার্থীরাও আসেন আহসান মঞ্জিলে। সম্প্রতি কয়েকজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার পর এই সংখ্যা কমে যায়। তবে গত কয়েকদিন ধরে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে, বলে বাংলানিউজকে জানান মবিনুল করিম। তবে ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে যে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোটি হতে যাচ্ছে আহসান মঞ্জিলে তা নিয়ে উৎসাহের শেষ নেই এখানকার কর্মকর্তা কর্মচারীদের। তাদের মতে, ওই অনুষ্ঠানে অনেক বিদেশি অতিথি আসবেন। এরপর আশা করা যায় বিদেশি দর্শনার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ