ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

লালপুর থেকে আসিফ ও শুভ্রনীল

মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ ছবি: শুভ্রনীল সাগর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালপুর, নাটোর থেকে: সুখীমাতা। স্বার্থক নাম বটে।

স্বয়ং জীবন যেনো স্বস্তির খোঁজে তার এলানো পায়ের কাছে বসে রয়েছে! গৃহী হলে এতোদিন নানি-দাদি হতেন। সেই কবে ঘর ছেড়েছেন। শুধুই কি ঘর?
 
জিজ্ঞেস করলে বলেন, মনে নেই। কেনর উত্তরে নির্লিপ্ত দৃষ্টি, সেই খোঁজেই তো ত্যাগ। কবে যে গোঁসাই হবো!
 
‘চাই না ধন জন মুক্তি
ওই চরণে থাকে ভক্তি
তার বা তুল্য কী?’
 
কী সেই গোঁসাই? কোন সে চরণ?
 
বেলা বাড়ে। আম পাতা-জাম পাতার ফাঁক গলে রোদ পড়ে আমাদের দৃশ্য জগতের অপরাহ্নে। তবু আঁধার কাটে না! ঘোর লাগে।
 
‘দাদা আমার নাম সঞ্জয় কুমার কর্মকার। শুনলাম, আপনারা এসেছেন। আমি এ আশ্রম পরিচালনা কমিটির সভাপতি। বলুন, আপনাদের কী সেবা করতে পারি?’ ঘোর কাটে।
 
‘শ্রী শ্রী ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের সৎসঙ্গ সেবাশ্রম’ নামটি ঢুকতেই চোখে পড়েছিলো। কিন্তু বোধগম্যতার আলো পৌঁছাচ্ছিলো না, ‘গোঁসাই’, ‘সৎসঙ্গ’, ‘সেবাশ্রম’ শব্দগুলোতে।
 
ভৌগলিক অবস্থানে নাটোর শহর থেকে প্রায় ৫৬ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে লালপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে দেখা মিলবে এ আশ্রম।
 
ফকির চাঁদকে আপাতত ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক, বাংলা ১১০৩ সালের দিকে ফকির চাঁদ বৈষ্ণব রামকৃষ্ণপুর আসেন। নওয়াপাড়ার জমিদার পুকুর ও জমিসহ ৪০ বিঘা সম্পত্তি দিয়ে আশ্রম গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। ১১০৪ সালে আশ্রম গড়ে ওঠে। এরপরও তিনি ১শ’ বছর বেঁচেছিলেন। ১২০৪ সালের মাঘ মাসে তিনি গোঁসাইপ্রাপ্ত হন।
 
সঞ্জয়ের ‘সেবা’ নিয়ে জানা যায়, ফকির চাঁদ একজন অবিবাহিত সিদ্ধ পুরুষ। তিনি এখানে ধ্যান-তপস্যার জন্য আসেন। তার বাবার নাম নবকৃষ্ণ, মা দশমতি, তারা তন্তুবায়ু পরিবার। মানে তাঁতী পরিবার। সেসময় পরাণ চাঁদ নামে তার একজন সহযোগী ছিলেন। দু’জন একসঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তিতে যেতেন। এলাকার মানুষ তাদের নানাভাবে নির্যাতন করতো। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আর ভিক্ষাবৃত্তিতে যাবেন না। এরপর গ্রামে দেখা দিলো কলেরা। মানুষ মরতে লাগলো। তখন সবাই ভাবলো, তিনি তো নিজেকে ফকির দাবি করেন, গিয়ে দেখা যাক। গ্রামের মানুষ তার কাছে গেলে, উনি অভয় দিয়ে ফেরত পাঠান। এরপর গ্রামে কলেরা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই তার ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ প্রকাশ পায়। এতে স্থানীয় জমিদার মদনমোহন তাকে আশ্রম তৈরিতে জমি দান করেন। তার বৈষ্ণব তত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে তৈরি হয় হাজারো ভক্ত।
 
তিনি ১২৭৪ খ্রিস্টাব্দে এখানে ভক্তসঙ্গ করতে করতে অদৃশ্য হয়ে যান। তার দেহ পাওয়া যায়নি, শুধু বস্ত্র পাওয়া যায়। সেটিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। আর সঙ্গী পরাণ চাঁদ দেহ রাখেন, তাকেও এখানে সমাধিস্থ করা হয়, যোগ করেন সঞ্জয়।
 
বৈষ্ণব ধর্ম সর্ম্পকে খুব সহজে বললে, এটি সনাতন ধর্মের একটি শাখা সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ে বিষ্ণু বা তার অবতাররা, বিশেষত- রাম ও কৃষ্ণ সবোর্চ্চ ঈশ্বর রূপে পূজিত হন। এ ধর্ম অনুসারীদের বলা হয় ‘বৈষ্ণব’।
 
এবার আসা যাক গোঁসাই পর্বে। এই স্তরে পৌঁছাতে গেলে শুরু থেকে শুরু করা ভালো। বৈষ্ণব ধমের মূল ভিত্তি হলো, ভক্তি। ভক্তি থেকে ভক্ত। ‘ভক্ত’ হলো প্রথম ধাপ। এজন্য ভক্তকে আশ্রমের প্রধান তিন উৎসবের যেকোনো একটিতে এসে সকালে স্নান করে নতুন সাদা কাপড় পরে ভাবের দীক্ষা নিতে হয়। আশ্রমের প্রধান সেবায়েত ভাব মন্দিরে তাকে ভাবদীক্ষা দেন। ভক্ত তার নিজের পছন্দের যেকোনো সাধুর কাছ থেকেও এ দীক্ষা নিতে পারেন। এরপর ভক্ত চাইলে গৃহে ফিরে যাবেন। তার সময়মতো আশ্রমে এসে বা নিজ বাড়িতে সাধুসঙ্গ মানে সাধুর কাছ থেকে জীবন-জগত সর্ম্পকে ভাবের পাঠ নিতে পারেন। ’
 
এছাড়া ভক্তের জন্য রয়েছে ‘ইষ্টবীথি’র সুযোগ। এটি হচ্ছে, রোজ এক টাকা বা সাধ্যমতো যেকোনো পরিমাণ টাকা জমা করা। এভাবে বছরান্তে জমানো অর্থ দিয়ে তিনি সাধুসেবা করতে পারেন। এটি অবশ্য পালনীয় কোনো নিয়ম নয়, সবই ভক্তের ইচ্ছা।
 
এর পরের ধাপ ত্যাগ। যিনি পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, ধন-দৌলত- মানে জাগতিক সবকিছু ত্যাগ করতে পারবেন, তিনিই আশ্রমবাসী হতে হবেন। বাহ্যিক ত্যাগের পর অভ্যন্তরীণ তথা ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, মোহ, হিংসা, লোভ ও মাৎসর্য) ত্যাগের সংগ্রাম। এভাবে ধীরে ধীরে যতোই তিনি সামনের দিকে এগুবেন, ততোই তিনি পা রাখবেন অন্য এক মানবতার দুনিয়ায়। যেখানে প্রেম-ভক্তি বিনা কোনো কিছুর স্থান নেই।
 
সঞ্জয় কুমারও এটি জোর দিয়ে বললেন, সনাতন ধর্ম থেকে বৈষ্ণব ধমের্র উৎপত্তি হলেও, বিভিন্ন সময়ে গোঁসাইরা তাদের ভাব-দর্শন দিয়ে একে সমৃদ্ধ করে গেছেন। এখন এটি উন্নততর এক মানবদর্শন। আমরা কোনো পুজা-অর্চনা করি না। মানবসেবাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়।
 
গোঁসাইরা যেমন লিখে গেছেন, ‘জীবে দয়া নামে রুচি বৈষ্ণব সেবন/ এর উপর ধর্ম নাই সনাতন। ’
 
ফিরে আসি সাধুতে। সাধুর চূড়ান্ত যাত্রা হলো গোঁসাই। এজন্য তাকে বেদ-বিধি, শাস্ত্র, জীবন-জগত, ধ্যান-তপস্যার এক অনন্য স্তরে পৌঁছাতে হয়। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলে তিনি নিজেই বুঝে যান। কেননা, ‘স্বরূপ বিনে রূপ দর্শন সম্ভব অতি’।
 
সদানন্দ, মঙ্গলময়, পরমানন্দ, সুখীমাতা, অনিলসহ দু’জন কর্মচারী। তারাই এ আশ্রমের বাসিন্দা। সদানন্দ সাধু আশ্রমের প্রধান সেবায়েত। ভক্তদের দীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আশ্রমের সবকিছু তিনিই দেখাশোনা করেন।
 
এর মধ্যে সঞ্জয়ের যাওয়ার তাড়া। কোথাও জরুরি কাজ রয়েছে। যাওয়ার আগে দশনার্থীদের  থেকে যাওয়ার জোর অনুরোধ।
 
শুনেই আমাদের চোখ কপালে।

এখানে ত্যাগী ব্যতীত থাকার নিয়ম রয়েছে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। অতিথিশালায় যতোদিন খুশি থাকতে পারেন। যে কেউ এসে থাকতে পারেন। আমরা মানবতার সেবক, এ আশ্রম তাই মানবের জন্য সদা উন্মুক্ত, সঞ্জয়ের বিনীত উত্তর।
 
আশ্রমে রয়েছে অমৃত কুণ্ডু নামে দিঘি, অক্ষয় কুণ্ডু নামে বট গাছ ও জিয়াদ কুণ্ডু বা জীবন দানকারী নামে কুয়া। কুয়ার পানি অসুখ-বিসুখসহ নানা প্রয়োজনে কাজে লাগে। উৎসবের সময় রান্না হয় দিঘির পানি দিয়ে।  

‘একসঙ্গে এখানে এক হাজারেরও বেশি লোকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসের দ্বিতীয়া রাতে ‘নবান্ন’, আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার রাতে ‘দোসরার চান’ ও চৈত্র মাসের দোল পূর্ণিমার উৎসবে তো অসংখ্য ভক্ত আসেন। নিজেরাই রান্না করে খেয়ে-দেয়ে সাধুসঙ্গ নিয়ে ফিরে যান। ’

‘তবে একটি সমস্যা!’
কী?
‘আপনাকে নিরামিষ খেতে হবে। আশ্রমে এটিই নিয়ম। ’
 
এমনি নিত্যদিন সাধুরা কী খান?
মানবসেবাই যার ধ্যান-জ্ঞান, সেকি আর এভাবে ছেড়ে যেতে পারেন। যেতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও কাজ ফেলে বলতে শুরু করেন সঞ্জয়, সকালে খালিপেটে প্রধান সেবায়েত ফকির চাঁদের মঠে ফুল দেওয়ার পর বাল্যসেবা (প্রাতরাশ) হিসেবে ফল-মূল, দুধ, মিষ্টান্ন আহার করেন। অন্নসেবায় (মধ্যাহ্নভোজন) ভাত, ডাল, সবজি আর অনরূপ সেবাও (নৈশভোজ) সকালের মতো।
 
‘সাধুদের আহারের জোগাড় আশ্রমই করে থাকে। এক্ষেত্রে আশ্রমের পুকুর-জমি থেকে আয় ও ভক্তদের দানই ভরসা। ’
 
এখানে পর্যটকদের আসার সুযোগ রয়েছে?
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের কাছে ভক্ত-অভক্ত সবই সমান। আমরাও চাই, সবাই আসুক, জানুক-বুঝুক। এসব তো আমাদের নয়, এ সবার।
 
নাটোর শহর থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দূরের এ আশ্রমে যাওয়া যায় সবসময়। তবে আশ্রমে যেতে সবশেষ এক কিলোমিটার রাস্তা মাটির। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো নয়। লালপুর বাজার থেকে দূরত্ব আট কিলোমিটার। দুড়দুড়িয়া বাজার এলে যে কেউ চিনিয়ে দেবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
এসএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ