ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

হারুয়া বাঁশঝাড়

‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬
‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’ ছবি: শুভ্রনীল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নাটোর থেকে ফিরে: ‘গণ্ডগোলের সুময়ের কোতা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এই রাস্তা দিয়ে যাতো।

তকন বাঁশঝাড় বিশাল ঘন কালো অন্ধকার আছিলো। প্রায় সুময় রাস্তার উপুর থেকে শুরু ক’রে বাঁশঝাড়ের মাতা পর্যন্ত বিশাল জোটাওয়ালা মানুষ দেকা যাতো। আর বাঁশঝাড়ের কেউ কোনো রকম ক্ষতি করতে চালেই তার বিশাল ক্ষতি হোতো। পাকিস্তানিরাও সমস্যাত পড়ছিলো সেই সুময়। তারা ভালো করে জানতো। তাই এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সুময় সালাম দিয়ে গ্যান যাতে বাদ্য হোতো’।

কথাগুলো এ নাগাড়ে বলে গেলেন হারুয়া বাঁশঝাড়ের পেছনের বাড়ির আব্দুল কাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুবক ছিলেন তিনি। তাই নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার রহস্যঘেরা হারুয়া বাঁশঝাড় নিয়ে জানতে চাইলে এভাবে শুরু করেন তিনি।

সত্যি গা ছমছমে। গল্পগুলো লোম খাঁড়া করা। বনপাড়া বাজার থেকে দয়ারামপুর রাস্তার কিলোমিটারখানেক এগুলেই হারুয়া। পিচঢালা রাস্তা থেকে বাঁয়ে ঢুকে গেছে ৫-৬ ফুটের কাঁচা রাস্তা। একটু দূরে তাকালেই ঘন বাঁশঝাড়। শীতের শিরশিরে মৃদু বাতাসে কালো পাতাগুলো দুলছে সামান্য। মাঝে মধ্যে কুচ ক্যাচ শব্দ।

প্রথমে ঢুকে কাউকে দেখা গেলো না। ঝাড়ের ঠিক নিচে খালি জায়গায় কতগুলি চুলা। বোঝা গেলা রান্না হয়েছে টাটকা। মরে আছে অনেক বাঁশ। কিন্তু কেউ কাটে না। দু একটি গর্তও চোখ এড়ালো না। বাঁশঝাড় ঘেঁষে ঈদগাহ মাঠ। নতুন নির্মিত। ঈদগাহের প্রায় দেয়াল ঘেঁষে একটি মাজার। ইট দিয়ে ঘেরা। প্লাস্টারবিহীন। উপরে টিনের চাল। উপরে তাকালে ‍আকাশ দেখা যায় না। কোনো পাশে বাঁশগুলো ঝুঁকে আছে অর্ধচাঁদ আকৃতিতে।

কিছুক্ষণ অবস্থান করে ফিরলাম রাস্তার দিকে। দেখা পাওয়া গেলো এ গ্রামের হারুয়া সরদার পাড়া গ্রামের আকলিমার। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা বাঁশঝাড় এরমই দেকে ‍আসিচ্চি। সোবাই এটি সিন্নি দিতে আসে। ঝাঁড়ের বাঁশ কাটলে তার অনেক ক্ষতি হয়।

কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতেই দেখা পেশায় কৃষক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে। সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন তিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান প্রজন্মের কয়েকজন দেখিয়ে দিলেন তাকে। বললেন, উনি পুরনো লোক, এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

আগ্রহ নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন। এই বাঁশঝাড়ের কিংবদন্তি সম্পর্কে জানতে চাইলাম তার কাছে। পাকিস্তানিদের ওই ঘটনা দিয়ে শুরুর পর আরও জানালেন, আমারে বাপ দাদাদের কাছেও এই বাঁশঝাড়ের একই গল্প শুনিছি। ওরাও আমার দাদার কাছে একই গল্প শুনিছে।

বলেন, এই বাঁশঝাড়ের বাঁশ কেউ কাটতে পারে না। কাটলেই তার ক্ষতি হয়। যেই এটি খারাপ মুন লিয়ে আসিছে বা বাঁশঝাড়ের কুনো ক্ষতি করার চেষ্টা করিছে তারই ক্ষতি হ’ছে। এটিকার কবরডা কার, তা কেউ বুলতে পারে না। নিজাম নাম করে এক পাগল থাকতো শুনিছি। প্রতি শুক্কুরবার এটি অনেক লোক আসে মানত করতে। কেউ কেউ সিন্নি দেয়। মুরগি, খাসি, খিঁচুড়ি রান্না করে খাওয়ায়। খাওয়ালে বেরাম সারে, মুনের ইচ্চা পূরণ হয়।

পাশে এরই মধ্যে জমে গেলো কয়েকজন। তবে কেউ ছবি তুলতে রাজি না। বেশ ধার্মিক সবাই। সব ধর্মের লোকেরই যাতায়াত এখানে।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সালাহউদ্দিন জোর গলায় বলে উঠলেন, ক্ষতি যে হয় তার বাস্তব প্রমাণ আমি নিজে। ছোটবেলাত একবার ওই বাঁশঝাড়ে পিসাব করিছিনু। তারপর আমার পিসাব বন্ধ হয়ে গেছিলো। পরে আমার মা সিন্নি দিয়ে মানত কোরার পরে ঠিক হছে। এরম ঘটনা আরও অনেকের হ’ছে।

কাদের বলেন, এই বাঁশঝাড়ের যেই ক্ষতি করতে আচ্চে, কেউ পাগল হয়ে গেছে, কারও গোলা দিয়ে রক্ত উটিছে, পেরালাইসিস হয়ে গ্যাছে- অনেক ঘটনা ঘটিছে। আমরাও নিয়মিত এটিকার সিন্নি খাই। কিছু দিন আগে এডা রোক্ষা করার জন্য পাশে একটা ঈদগাহ করা হছে।

আব্দুল জলিল কথা টেনে নিয়ে বললেন, শুনিছি এটি মাদারের আসন আছিলো। একোনো আছে। কিন্তু এডা বুলা যাবি না। আরও একটা কোতা বুলতে পারি। একবার আমার এক খালাতো ভাই এই বাঁশঝাড়েত থেকে একটা শুকনা বাঁশ কা’টে লিয়ে পুড়াছিলো। সাতে সাতে ওর নাক মুক দিয়ে রক্ত পোড়া শুরু হোলো। পরে দুইডা খাসি মানত করে ত্যানেগান বেরাম সারে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে নাটোর, সিরাজগঞ্জ এমনকি ভারত থেকেও মানত করতে লোক আসে। বেশি আসে শুক্রবার। তারা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য মানত করলে সেরে যায়।

শুরুর কথা জানতে চাইলে জলিল বলেন, শুরুর কোতা কেউ বুলতে পারে না। মুনে করেন, বাপ-দাদারে কাছে শুনিছি এটি বিশাল জোটাধারী এক লোক বাস করে। তাক কয় ‘মাদার’। মরে না। মাজে মধ্যে দেকা দেয়। রাস্তা থেকে ঐ গ্রাম পর্যন্ত তার পা পড়ে। কিন্তু কারও ক্ষতি করে না। সেই রক্ষাকোর্তা।

এভাবেই কয়েকশো বছর ধরে এ বিশ্বাসের উপর তৈরি হয়েছে নানান কিংবদন্তি। গ্রামের মানুষ সেই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নিত্য জীবনযাত্রা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি/জেডএম

** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ