ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

হজরত বায়েজিদ বোস্তামীর প্রিয় কাছিমেরা

সৈয়দ ইফতেখার আলম ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
হজরত বায়েজিদ বোস্তামীর প্রিয় কাছিমেরা ছবি: শুভ্রনীল সাগর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: বগুড়া থেকে নাজমুল হক সুদূর চট্টগ্রামে এসেছেন। হাতে কাঠি, তাতে আবার খাবার গুঁজে দিচ্ছিলেন।

সহযোগিতায় পাশে তার এক আত্মীয়। দু’জন মিলে নেমে গেলেন পুকুরপাড়ে। ঠিক সেই সিঁড়িটায় দাঁড়ালেন যেটাতে পানি স্রোতের মতো ভেসে আসে না। পুকুরে আবার স্রোত কিসের, এমন প্রশ্ন জাগতে পারে। তার আগেই বলে রাখা ভালো— এই জলাশয়ে যে বিশালাকার শ’ শ’ সরীসৃপের বাস।
 
কাছ থেকেই ওই দুই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করা। সরীসৃপগুলোকে কাঠি দিয়ে পরোটা ও কলা খাওয়ালেন। পরে নাজমুল হকের আত্মীয় সেখান থেকে একটি প্রাণীকে ধরে কচলে-কচলে গোসল করানো আরম্ভ করলেন!

ভাই নাম কী আপনার? - নজরুল হক।
চট্টগ্রামেই থাকেন? - না, আমরা বগুড়া থেকে এসেছি।
উদ্দেশ্য? - হজরত বায়েজিদ বোস্তামীর (র.) প্রিয় কাছিমদের খাওয়াবো বলে। সঙ্গে মাজার জিয়ারতও হবে।
নিয়মিত আসেন? - না, এবারই প্রথম।
‘প্রিয়’ কাছিম কেন? - মান্নত নিয়ে এসেছি। শুনেছি এখানে কাছিমদের খাওয়ালে, তাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে- মান্নত পূরণ হয়।

শুধু তিনিই নন, কাছিমদের নিজ হাতে খাওয়াচ্ছিলেন গৃহিণী ফারহানা মিনু। থাকেন নগরীর অক্সিজেন এলাকায়। মনের ইচ্ছে যেন সহজেই পূরণ হয় সেই বাসনা নিয়ে ছুটে এসেছেন। জানালেন, এর আগে মাজারের কাছিমদের খাইয়ে ফলও পেয়েছেন।
 
ফারহানা বলেন, নিয়ত করে খাদ্য দিলে উপকার হবেই। এই মাজারটি যার সেই হজরত বায়েজিদ বোস্তামী ভালোবেসেছিলেন কাছিমগুলোকে। তার মতো সুলতান-উল আরেফিন, আল্লাহওয়ালার মাজারে এসে তারই ভালোবাসার প্রাণীগুলোকে খাওয়ালে যেমন খুশি হবেন তিনি, ঠিক তেমনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনাও কবুল হবে, এমনটাই সত্য।

শুধু নজরুল-ফারহানাই নন, আরও দেখা পাওয়া গেলো নাজমুন নাহার, রাজু, বকুলসহ নাম না জানা অনেকের। প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য, খানিক সন্তুষ্টি অর্জন, নিয়ত-মান্নত পূরণ। ভেদাভেদহীনভাবে আসেন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও।

পুকুরের পাশেই দাঁড়িয়ে পরোটা নয়, পরোটা নয়, কলা নয়- ‘গোস্ত-ফুসফুস-মিষ্টি’ বলে হাঁকডাক দিচ্ছিলেন মোহাম্মাদ আলী ফকির। বয়স ৬২ জানালেও দেখে বোঝার জো নেই।

এসব আওয়াজের কারণ কী, জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ভালো খাবারের প্রতি আগ্রহ মানুষের যেমন, ঠিক তেমনি এই প্রাণীগুলোরও। ওদের প্রিয় খাবার কাঁচা ফুসফুস। যে কোনো মাংসও খাবে। রসগোল্লা বা মিষ্টি হলেও মন্দ নয়। মন থেকে আশা নিয়ে খাওয়াচ্ছেন; ভালো জিনিসই তো দেওয়া উচিত। তাতে খাবার নষ্ট হবে না, নোংরা হবে না পুকুরের পরিবেশও।

মাজারের কাছিমগুলো নিয়ে তিনি বলেন, শত বছরের জনশ্রুতি থেকে জানা যায়- এই অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালে (৯০০ সালের দিকে) প্রচুর দুষ্টু জ্বিন ও আত্মার আনাগোনা ছিল। বায়েজিদ বোস্তামী এখানে ভ্রমণকালে এসব অশরীরীদের শাস্তিস্বরূপ কাছিমে পরিণত করেন। সেই সঙ্গে আজীবন পুকুরে বসবাসের দণ্ডাদেশ দেন। তখন কাছিমরা বলেছিল- এমন পুকুরে থাকলে তাদের খাদ্য দেবে কে? বায়েজিদ বোস্তামী উত্তরে বলেছিলেন- এই দায়িত্ব মানুষের।

‘এছাড়া কাছিমগুলো তার অনেক প্রিয়ও ছিল’।

তবে প্রিয় কাছিমের বাসস্থান এতো ময়লা-অপরিষ্কার কেন? জবাবে আলী ফকির বলেন, মানুষ যে খাইয়ে যায় এরপর আর সেভাবে পরিষ্কার করা হয় না। এতে দিন দিন পানি নোংরা হচ্ছে, চারপাশে ময়লা ফেলছে অসচেতন মানুষ- ফলে সামগ্রিকভাবে দূষিত হয়েছে পরিবেশ। এছাড়া পুকুরপাড়ও সংস্কার হয় না কয়েক বছর, সে জন্য ময়লা-আবর্জনাতে ভরে গেছে জলাশয়ের একাংশ।

এ বিষয়ে তিনি মাজার কর্তৃক্ষের অবহেলাকে দায়ী করলেন। সরেজমিন ঘুরেও যার সত্যতা মেলে। বায়েজিদ বোস্তামী মাজারসংলগ্ন পুকুরের চারটি পাড়ের একটি অংশ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা। মহাসড়কের পাশে পুকুরের পুব পাড় এক সময় উর্বর প্রজননক্ষেত্র ছিল। তবে সেখানে মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ায় এখন আর ওই স্থানে ডিম পাড়ে না, সঙ্গে ডিম পাড়তে উপযুক্ত স্থানের অভাবে ভুগছে কাছিমরা।

এদিকে, ময়লা পানিতে দিন-দিন কমছে প্রজনন শক্তি। পুকুর ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ, কাক-কুকুর-বিড়ালসহ নানা প্রাণী কাছিমের ডিম খেয়ে ফেলার কারণে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে প্রজননে। পাশাপাশি মাজারে আগত ভক্তদের দেওয়া খাবারে পানির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে।

শুষ্ক মৌসুমে পুকুরটির গভীরতা আড়াই মিটার ও বর্ষায় পাঁচ মিটারে দাঁড়ায়। তবে সব সময়ই থাকে ময়লা। এমন পানিতে কাছিমগুলো বসবাস করে শরীরে ক্ষত এবং রোগবালাইয়ের সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে স্কিন ফাঙ্গাস (ত্বকে আক্রমণকারী ছত্রাক)। এতে সার্বিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে তাদের প্রজননে।

প্রজনন মৌসুমে বন বিভাগের কর্মকর্তারা কয়েকবার পরিদর্শন করে ডিম গণনা করেন। এছাড়া এই প্রাণীগুলোকে সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। এ নিয়ে সরকারের কোনো বরাদ্দও নেই।

এক সময় ভারতে এসব কাছিমের দেখা মিলতো। বর্তমানে বায়েজিদ বোস্তামীর (র.) মাজার প্রাঙ্গণ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও সেভাবে দেখা পাওয়া যায় না। স্থানীয়রা এই কাছিমকে মাজারী ও গজারী বলে আখ্যা দেন। যাকে বোস্তামী কাছিমও বলা হয়। তাদের প্রজনন মৌসুম মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এই ধরনের কাছিম রয়েছে বিলুপ্তির তালিকায়।

বলা চলে বায়েজিদ বোস্তামী (র.) দরগাহ শরীফের ৯৮ দশমিক ৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৬১ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের পুকুরটিই এখন বোস্তামী কাছিমের অভয়াশ্রম। মানুষের বিশ্বাস, একটি প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা এবং জীব বৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ- যাই বলা হোক না কেন- কাছিমদের জন্য সুন্দর পরিবেশ সুনিশ্চিত করা সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
আইএ/এসএস/

** শঙ্কা নিয়েও মাটির পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বাস
** ভাবনা-উদ্যোগের অভাব, প্রাচুর্য সৌন্দর্যের

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ