ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

আট প্রহরই সাগরের সঙ্গে মিতালি

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৬
আট প্রহরই সাগরের সঙ্গে মিতালি ছবি: সোহেল সারওয়ার - বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সেন্টমার্টিন থেকে: প্রবাল বনে বসে চুপচাপ পানি পানে তাকিয়ে বার্মিজ এক কুকুর। চকিতে সজাগ হয়ে একটা মাছ মুখে তুলেই দে ছুট।

আশপাশে মাছ খুঁজতে থাকা আরও ক’টি কুকুর পিছু নিলো তার। কুকুরের পেছনে কুকুর ছুটছে এবার। তীরে উঠে সব ক’টা হারিয়ে গেলো কেয়ার ঝোপে।

সেন্টমার্টিন জেটি থেকে ১৫৪ ডিগ্রি দক্ষিণে মিনিট দশেক হাঁটার পর এই প্রবাল পাথরের বন। অসংখ্য ছোট বড় প্রবালের ফাঁকে ফাঁকে ছিপ ফেলে মাছ ধরছেন ক’জন দ্বীপবাসী। ঢেউয়ে ভেসে আসা পানিতে পলিতে ঘোলা হলেও প্রবাল পাথরের ফাঁকে স্ফটিক স্বচ্ছ পানি।


সৈকত এখানে সোজা এগিয়ে গেছে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত। পুরো সৈকত জুড়েই শামুক ঝিনুকের চূর্ণ বিচূর্ণ অংশ, হরেক রঙা আস্ত শামুক-ঝিনুক।

সামনে বর্ষা। সাগর তীরে তাই নতুন নৌকা তৈরির আয়োজন। কোস্টগার্ড আর নৌবাহিনীর এলাকা পেরোনোর পর হঠাৎ বকের গলার মতো সরু হয়ে এলো দ্বীপের শরীর।

জায়গাটির নাম গলাচিপা। এরপর দক্ষিণপাড়া নামে আর একটিই জনবসতি সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে। তারই মুখে মেরিন পার্ক।


সমুদ্রের ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত কচ্ছপের প্রজননই মূল কাজ এখানে। পানির বাসিন্দা হলেও সৈকতে উঠে ডিম পাড়ে কচ্ছপ। এই মেরিন পার্কের কাজ হলো সেগুলো ঠিকঠাক ফুটানোর ব্যবস্থা করা। সঙ্গে গবেষণা- সব সামুদ্রিক জীবন নিয়ে।

কিন্তু মেরিন পার্ক এখন বন্ধ। সামনের চত্বরে দেড় মানুষ সমান উঁচু নারিকেল গাছগুলো হলদে বর্ণ নিয়েছে। কচ্ছপের ১১টি খাঁচার সব ক’টিই খালি। প‍ুব পাশের দালানঘরে বোতলজাত সামুদ্রিক সাপ, সাপের ডিম।

গলাচিপার নাম এখন অবশ্য নজরুলপাড়া। কোনো ব্যক্তির নামে এই একটিই পাড়া সেন্টমার্টিনে। বাকিগুলো উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মধ্যপাড়া ইত্যাদি নামে।
স্থানীয় যুবক রফিক আলম জানালেন, নজরুল নামে এক সার্ভেয়ার একবার এসেছিলেন এখানে। তিনি তার জরিপ কাজের নথিতে গলাচিপাকে নিজের নামে রেকর্ড করেন। তারপরই এ পাড়ার নাম হয়ে যায় নজরুলের নামে।

গলাচিপার শ’দুই মিটার জমি পেরিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। পূর্বে শান্ত হলেও পশ্চিমে ফুঁসছে সাগর। প্রবাল বনে বাড়ি খেয়ে নাচছে ঢেউয়ের পর ঢেউ। সেই পানির গর্জন সাগরের হুঙ্কার হয়ে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।


প্রবাল পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট শামুক আর কাঁকড়ার বিচরণ। ডাব কেটে খাওয়া হলো প্রবালের ওপরে বসে।

কোমেনের আঘাতে হেলে গেছে এ পাড়ের অধিকাংশ নারিকেল, ঝাউ আর কেয়া গাছ। ফাঁকে ফাঁকে রিসোর্টের ছড়াছড়ি। এসব রিসোর্টে থেকে চব্বিশ ঘণ্টা সাগরের গর্জনের সঙ্গে মিতালি গড়া যাবে। এ এক অভাবনীয় পরিবেশ সেন্টমার্টিনে। দ্বীপের যে কোনো স্থান থেকেই সাগরের গর্জন শোনা যায় আটপ্রহর জুড়েই। কতোগুলো কটেজের সামনে তো মাথা সমান উঁচু মাচা বেঁধে সাগর দর্শনের আয়োজন। তাঁবু ফেলে ইকো রিসোর্টের স্লোগান ঝুলছে কোথাও কোথাও।

ক্ষয়িষ্ণু বালিয়াড়ির পেছনে একটি খড়ের গাদাও চোখে পড়লো তীরবর্তী ঝোপের ফাঁকে। ছাগল আর মুরগি খেলছে একটি ঘরের উঠোনে।


এদিককার সৈকতে ছোট ছোট কাঁকড়ার গর্ত। বালির বুকে নিপুণ আলপনা এঁকেছে কাঁকড়া। কোথাও কোথাও গর্ত খুঁড়ে তুলে নেওয়া হয়েছে কাঁকড়া। ব্যবহার করা হবে মাছের টোপ হিসেবে।

ঢেউয়ের আগায় ভেসে সৈকতের বালুতে এসে পড়ে রয়েছে গোটা পাঁচ কোরাল মাছের বাচ্চা। জেলেদের জালে আটকে মরে গেছে সব।

দূরে পানির ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক প্রবাল দ্বীপ। কোনো গাছ-ঘাস এখনও জন্মায়নি প্রবালের বুকে। ওই দ্বীপেরই ওপাশে হঠাৎ হারিয়ে গেলো এতোক্ষণ ধরে সাগরের উপরে ঝুলে থাকা সূর্যটা।

পশ্চিম থেকে উত্তর সৈকতে বেরিয়ে আসতেই আরও বেড়ে গেলো সাগরের গর্জন। ভরা জোয়ারে ভর করে পানি যেনো হুট করে লাফ দিচ্ছে এদিকটায়। তীরে পানিতে না নামার সাবধানতা বুঝিয়ে দিচ্ছে-চোরাবালি আর তলস্রোতের আধিক্য বিপদের কারণ হতে পারে এদিকটায়।

কবরস্থান ডানে রেখে আরও খানিক এগোতেই শেষ হয়ে এলো সেন্টমার্টিন প্রদক্ষিণ। ঘণ্টা তিনেক হেঁটে চক্কর দেওয়া গেলো সেন্টমার্টিনের সৈকত ঘিরে।


এই সেন্টমার্টিন তো বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। যার অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব কোণে। আর এই বঙ্গোপসাগরই পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর। আয়তন প্রায় ২২ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এই উপসাগরের পশ্চিম দিকে রয়ছে ভারত ও শ্রীলঙ্কা, উত্তর দিকে রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে মায়ানমার ও ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।

আর সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয় যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। যার পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিকজুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।

ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তরপাড়া। দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় দক্ষিণপাড়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সঙ্কীর্ণ লেজের মতো এলাকা এবং সঙ্কীর্ণতম অংশটি গলাচিপা (নজরুলপাড়া) নামে পরিচিত।


বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৬
আইএ/জেডএম/

** মেঘের সাগরে আয়েসি উড়াল
** হাওয়া অফিস খাঁ খাঁ, ঐতিহ্যের শরীরে টাইলস আগ্রাসন
** বাংলানিউজ, ওয়েলকাম টু কক্সবাজার
** আতঙ্ক আর আনন্দ একযোগে ভর করলো সাগরে
** এই ৮ বর্গকিমিই এনেছে ৪ হাজার বর্গকিমি সমুদ্র
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ