ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বিলুপ্ত হাঙরের ‘বৈধ’ হাট

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৬
বিলুপ্ত হাঙরের ‘বৈধ’ হাট ছবি: সোহেল সরওয়ার - বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কক্সবাজার থেকে: কক্সবাজার উপজেলা সদরের জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা ড. মঈন উদ্দিন আহমেদের মতে, সাগর প্রাণীর মধ্যে বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তপ্রায় হয়ে উঠছে হাঙর। সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকলেও হাঙর শিকার না করার জন্য তারা নিয়মিত জেলেদের নির্দেশনা দেন, হাঙর রক্ষায় সচেতন করার চেষ্টা করেন।



মৎস্য কর্মকর্তা শনিবার (৯ এপ্রিল) সকালে কক্সবাজার সদরের ফিশারিঘাটে বসে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার সামনেই বসেছিলো হাঙর বিক্রির হাট। সরকারি পাইকারি মৎস্য অবতরণ ও পাইকারি মৎস্য বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে হাঙর।

ফিশারি ঘাট নামে পরিচিত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটিতে যতো সামুদ্রিক মাছ এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে হাঙর। মাঝারি ইলিশ, জাটকা, অক্টোপাস, শাপলা মাছ, পাতা মাছ, পাখি মাছ, পাইন মাছ, সাগরের শোল, টুঠ্যা, ছুরি, লাল চিংড়ি, সাগরের বাইন, লইট্যাসহ কমপক্ষে ২০ ধরনের সামুদ্রিক মাছের দেখা মিলেছে ফিশারি ঘাটে।

তবে হাঙরের বিভিন্ন প্রজাতি ছাপিয়ে গেছে অন্য সব মাছের সমাহারকে। কালা হাঙর, কাইন্যা হাঙর, মইল্ল্যা হাঙর, লতা হাঙর, কলা হাঙর, পদুয়ানি হাঙর, গাববারা হাঙর, পীতাম্বরি হাঙর, আডাইল্যা হাঙর, খড়গ হাঙর, ফুলাইশ্যা হাঙর ও জুতা হাঙর এসেছে এ অবতরণ কেন্দ্রটিতে।

এতোসব হাঙর কি গভীর সাগরে জালে ধরা পড়ে? প্রশ্ন ছিল পাইকারি বিক্রেতা আর ট্রলারের জেলেদের কাছে। ট্রলারের জেলেরা কোনো সদুত্তর দেননি, এড়িয়ে গেছেন পাইকারি বিক্রেতারাও।

তবে বাজারের একপাশে কিছুটা নির্জনে ডেকে নিয়ে জবাবটা দিলেন ফিশারি ঘাটের পাইকারি বিক্রেতা মো. তাজউদ্দিন ও আবু তাহের।

তারা জানালেন, আগে শুধু জালেই মাঝে মাঝে হাঙর ধরা পড়তো। এজন্য বাজারে কখনও খুব বেশি হাঙর দেখা যেতো না। কিন্তু সম্প্রতি ট্রলার মালিক আর মাছ ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টে ফেলছেন।

‘এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেখে ট্রলার থেকে বড়শি ফেলা হয় গভীর সাগরে। সেই বড়শি গলায় আটকে গেলে শক্তিমান হাঙর মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। কয়েক বছর ধরে এভাবেই ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঙর। ’

হঠাৎ হাঙর শিকারের ধুম কেন? জানতে চাইলে এই দুই বিক্রেতা জানান, কয়েক বছর ধরে তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজারের বিভিন্ন শুটকি পল্লীতে হাঙরের চাহিদা বেড়েছে। হাঙরের তেলও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। আর বিদেশেও এখন হাঙরের চাহিদা বাড়ছে।

‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও যখন জোর নজরদারি নেই, তখন মাছ ব্যবসায়ীরা বাড়তি আয়ের সুযোগ ছাড়বেন কেন?’

ঢোকা যাক হাঙরের হাটে। কালা হাঙর আয়তনে ছোট, ওজনও খুব বেশি নয়। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম, সর্বোচ্চ এক কেজি পর্যন্ত হয়। কাইন্যা হাঙর সর্বোচ্চ ছয়-সাত কেজি পর্যন্ত হয়। কাইন্যা হাঙরের কান বড় বড়, ওপরের দিক ধূসর আর নিচে সাদা। কালা হাঙর কেজিপ্রতি ১০০ টাকা আর কাইন্যা হাঙর কেজিপ্রতি দেড়শ টাকা দাম হাঁকাচ্ছিলেন পাইকারি বিক্রেতা আবুল কাশেম।

মইল্যা হাঙর সর্বোচ্চ ২০ মণ ওজনের হয়। এই হাঙর জাল দিয়ে ধরা যায় না। কেবল বড়শিতেই কুপোকাত হয় সে। তাজউদ্দিন মইল্যা হাঙরের দাম হাঁকাচ্ছিলেন প্রতিকেজি ১৮০ টাকা। বাজারে লতা হাঙরও নিয়ে এসেছেন তিনি। লতা হাঙর সর্বোচ্চ তিন’শ কেজি পর্যন্ত হয়। প্রতি কেজি দাম ১৩০ টাকা।

কলা হাঙরের ওজন সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। পেট মোটা, উপরে ধূসর আর নিচে সাদা রংয়ের এই মাছের দাম ফিশারি ঘাটে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা।

পদুয়ানি হাঙর লম্বা আকৃতির, পিঠ সাদা, নিচে কিছুটা লালের মিশ্রণ আছে। এক কেজি থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কেজি পর্যন্ত পদুয়ানি হাঙরের ওজন হয় বলে জানিয়েছেন বিক্রেতা আবু তাহের।


একেবারে ব্যতিক্রম ধরনের হচ্ছে গাববারা হাঙর। দেখে মনে হবে, যেন সাগর জলে ভাসছে পদ্মপত্র। ওপরে সবুজাভ, নিচে সাদা, আর পেছনে আছে ব্যাঙাচির মতো লেজ। পাতার মতো দেখতে মাছটিও সর্বোচ্চ ১২০ কেজি পর্যন্ত হয় বলে জানালেন আবু তাহের।

তবে ফিশারি ঘাটে দেখা গেছে, এক থেকে দেড় কেজির গাববারা হাঙর। দাম হাঁকানো হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা।


গাববারার মতো আরেক ব্যতিক্রমী মাছ হচ্ছে জুতা হাঙর। কুচকুচে কালো হাঙরটির মুখের পেছনের অংশ খাঁজ কাটা। দেখে মনে হবে জুতার নিচের অংশ। জুতা হাঙর সবসময় পাওয়া যায় না, তবে শনিবার দুই নৌকায় ভরে জুতা হাঙর এসেছে ফিশারি ঘাটে। দরদাম তখনও ঠিক হয়নি।

জুতা হাঙরের মতো আডাইল্যা হাঙর আর ফুল্যাইশ্যা হাঙর, খড়গ হাঙরও সবসময় পাওয়া যায় না। কয়েকদিন আগে জালে ধরা পড়া কয়েকটি আডাইল্যা, ফুলাইশ্যা ও খড়গ হাঙর বাজারে এলেও সেগুলো ভোরেই বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান পাইকারি বিক্রেতা আবুল কাশেম।

ফিশারি ঘাটে পীতাম্বরি হাঙর কয়েকটি দেখা গেছে, যেগুলো আনুমানিক ১০-১২ কেজি করে। তবে পীতাম্বরি হাঙরের ওজন সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি পর্যন্ত হয়। বিক্রেতা পীতাম্বরি হাঙরের দাম হাঁকাচ্ছেন কেজিপ্রতি ২৩০ টাকা।

আরেক ধরনের হাঙরের কথা জানালেন আবুল কাশেম, যার নাম লগা হাঙর। বিস্ময়কর তথ্যও দিলেন তিনি। বললেন, ‘লগা হাঙর সহজে ধরা পড়ে না। যার বড়শিতে ধরা পড়বে তার লাইফ মার্ডার। ব্যবসা শেষ। ’

পাইকারি বিক্রেতা তাজউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, বঙ্গোপসাগরের গভীরে ট্রলার থেকে বড়শি ফেলে অথবা জাল দিয়ে হাঙর ধরা হয়। ট্রলার থেকে নৌকায় করে সেগুলো নিয়ে আসা হয় ফিশারি ঘাটে।

হাঙর বিক্রি নিয়ে প্রশাসনের ‘ঝুটঝামেলা’ এড়াতে দর কষাকষির জন্য বিক্রেতারা গঠন করেছেন সমিতি। হাঙর ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি নামে ওই সংগঠনে ৮০ জন সদস্য আছেন।

সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক হোসেন আহমেদ সওদাগর বাংলানিউজকে জানালেন, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনকে ট্যাক্স দিয়েই তারা হাঙর সংগ্রহ ও বিক্রি করেন।

ট্যাক্স দেওয়ার স্লিপও দেখালেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার ড. মঈন উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। এজন্য আমরা জেলেদের কোনো চাপ দিতে পারি না। তবে আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিলৈ ০৯, ২০১৬
আরডিজি/এমএ

**
সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ