ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

নাফ নদীতে বাঁধা জীবনতরী

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৬
নাফ নদীতে বাঁধা জীবনতরী ছবি: শুভ্রনীল সাগর - বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কক্সবাজার থেকে: শুরুতেই অন্য প্রসঙ্গ। নাফ নদী লিখে গুগলে সার্চ দিন।

ইন্টারনেট দেখাবে- ‘নাফ নদী থেকে ...হাজার ইয়াবা উদ্ধার’, ‘অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় নাফ নদী থেকে আটক...জন’, ‘নাফ নদীর ...টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে’। এরকম আরও কতো নেতিবাচক শিরোনাম!

মনুষ্য সৃষ্ট সংকটের আড়ালে পড়ে নাফ নদী যেনো তার আসল পরিচয়টাই হারিয়ে ফেলেছে। কারণ নাফ নদীর বড় পরিচয়গুলো যে ইতিবাচকই। এর কিছু নমুনা দেওয়া যায়। বাংলাদেশ ও মায়ামারের বাণিজ্য সম্পাদিত হয় এই নদীর মাধ্যমেই। এই নদীর পানির ওপর ভরসা করেই টেকনাফে তৈরি হয়েছে ২৪ হাজার একর লবণ মাঠ, যাতে লবণ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছে উপজেলার ১৪ হাজার পরিবার। দেশের দক্ষিণের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেন্টমার্টিন যেতে হয় এই নদীর উপর দিয়েই। সামুদ্রিক মাছের জন্যও কি কম বিখ্যাত এই নাফ?বাংলাপিডিয়া বলছে, কক্সবাজার জেলার সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব কোণ দিয়ে প্রবাহিত প্রলম্বিত খাঁড়ি সদৃশ নাফ নদী মিয়ানমারের আরাকান থেকে কক্সবাজার জেলাকে বিভক্ত করেছে। জেলার দক্ষিণে এটি একটি বড় নদী। আরাকান ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের অন্যান্য পাহাড় থেকে উৎসরিত নাফ নদী বঙ্গোপসাগরে এসে পড়েছে। ১.৬১ কিমি থেকে ৩.২২ কিমি প্রস্থবিশিষ্ট এই নদী জোয়ারভাটা প্রবণ। নদী তীর সংলগ্ন জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত উপকূলীয় সমভূমি (যেমন- কদমভূমি) ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ নাফ নদীর ডান তীরে অবস্থিত। মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর নাফ নদীর বাম তীরে অবস্থিত। শুক্রবার (৮ এপ্রিল) সারাদিন বাস্তব চিত্র দেখতে নদীর বাংলাদেশ পাড়ের বিভিন্ন অংশে চষে বেড়িয়েছে বাংলানিউজ টিম।

টেকনাফ সদর থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বে উপজেলার চৌধুরী পাড়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে নতুন ট্রানজিট ঘাট। এ ঘাট দিয়েই চলবে বাংলাদেশ-মায়ানমারের বাণিজ্যিক কার্যক্রম।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘাট তৈরিতে কাজ চলছে জোরেশোরে। একটি জাহাজে করে চট্টগ্রাম শহর থেকে আনা হয়েছে লোহা সিমেন্ট। ঘাটের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজই শেষ। সেই কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে ২০-২৫ জন শ্রমিক অনবরত কাজ করে যাচ্ছেন। এমন সময় কথা হয় ইউসুফ নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রায় একবছর ধরেই ঘাট তৈরিতে কাজ করছি। প্রায় কাজই শেষ। আশা করছি কয়েকমাসের মধ্যেই পুরো ঘাট তৈরি হয়ে যাবে।

শুধু কি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করার জন্যই ব্যবহৃত হবে এই ঘাট। হয়তো না। পর্যটকদের টেকনাফ ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণে এই ঘাটও থাকবে তা নিশ্চিত। কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঘাট দেখতে আসতে শুরু করেছেন তারা।

ঢাকার আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই বন্ধু তানভির ও আশরাফুল চলে এসেছেন ঘাট দেখতে। তারা বাংলানিউজকে বলেন, পত্রিকায় পড়েছিলাম এখানে নতুন ঘাট হচ্ছে। টেকনাফে আসলাম সেই ঘাট দেখে যাবো না, তা হয় নাকি?টেকনাফ সদর পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে এগোতেই ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট দিয়েই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নাগরিকেরা নাফ নদীর ওপর দিয়ে বৈধভাবে দুই দেশে আসা-যাওয়া করে। ১৯৮৫ সালের বাংলাদেশ-মিয়ানমার বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এটি হয়ে আসছে।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের ১৪জন রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছেন চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে। মূলত ব্যবসায়িক স্বার্থে বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও প্রায় রোহিঙ্গা নাগরিকই আসেন চিকিৎসার কাজে।

ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে কথা হয় মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের অধিবাসী সত্তরোর্ধ্ব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি চিকিৎসা শেষে মিয়ামনারে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন।

আবদুল্লাহ বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে শরীরজুড়ে বাতের ব্যথা। আমাদের তো মংডু শহরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই ভালো চিকিৎসাও পাই না। সাতদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলাম। কক্সবাজারে চিকিৎসা করেছি। এখন চলে যাচ্ছি।

তিনি জানান, নাফ নদীর ওপর দিয়ে বাংলাদেশে আসতে জনপ্রতি খরচ হয় তাদের মুদ্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার মতো। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তিনশ’ টাকা। বাংলাদেশে আসতে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো নাফ নদীর ওপর ট্রলারে চড়তে হয় তাদের। একই রাজ্যের নুরুল আমিন নামের আরেক অধিবাসী বাংলাদেশে এসেছেন তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে।

নুরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আমাদের ওখানে এরকম রোগীর খারাপ অবস্থা হয়ে গেলে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাই আগেভাগে চলে এলাম স্ত্রীকে নিয়ে। সাতদিনের জন্য এদেশে থাকার অনুমতি নিয়েছি।

চেকপোস্টের ইমিগ্রেশন অফিসার এএসআই আবুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিনই ২০-২৫ জন করে রোহিঙ্গা অধিবাসী বাংলাদেশে আসেন চিকিৎসা ও ব্যবসার কাজে। আবার বাংলাদেশিরাও নিয়মিত সেখানে যান ব্যবসার কাজে। রোহিঙ্গাদের এদেশে আসতে পাসপোর্ট লাগে না। ওই দেশের ইমিগ্রেশন বিভাগের অনুমতিপত্র দেখালে আমরা ৫০ টাকার বিনিময়ে তাদের তিনদিন বাংলাদেশে থাকার অনুমতি দিই। এর চেয়ে বেশিদিন থাকতে হলে প্রতিদিনের জন্য ২০০ টাকা করে চার্জ নিই। তারা সর্বোচ্চ ৯০ দিন থাকতে পারবে বাংলাদেশে। আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে নাফ নদীই দুই দেশের মানুষের ভরসা। ’

খালী চোখে দেখলে দেখা যায়, এই নদী পৃথক করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে। একটু গভীরে গেলে বেরিয়ে আসে অন্য অর্থ। এই নদী দুই দেশকে সংযুক্তই করেছে। তা নয় কি?

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৬
টিএইচ/এমজেএফ/

** স্বামীর ওয়াদা রক্ষায় ছেঁড়া দ্বীপে বসবাস রহিমার
** ১৮ কোটি টাকার মেরিন পার্ক ১০ বছরেই ‘মৃত’
** আখেরি স্টেশন দোহাজারী, কক্সবাজারে রেল কবে?
** বয়সটা কম, তবুও কাঁধটা ‘বড়’ তাদের..
** ঘোড়া চলে ঘুষ দিয়ে !
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ