ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

শাহেন শাহ-হিমপরির ভালোবাসার নিদর্শন দরিয়ানগর

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৬
শাহেন শাহ-হিমপরির ভালোবাসার নিদর্শন দরিয়ানগর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কক্সবাজার থেকে:  হিমপরির নৃত্যশালা মুগ্ধ করছে পর্যটকদের। প্রাকৃতিক পাহাড়ের গুহায় নৃত্য করতেন হিমপরি ও তার সখিরা।

পরিদের অপরূপ চেহারা আর মনোমুগ্ধকর নৃত্য দরিয়ানগরের পাহাড়কে আলোকিত করে রাখতো। বানাছা পরির কন্যা হিমপরি মাঘী পূর্ণিমার রাতে তার সখীদের নিয়ে সমুদ্রস্নান সেরে এই পাহাড়ের নিচে নৃত্যগীত করতেন।

তাই হিমপরির নামে জায়গার নামকরণ ‘হিমছড়ি’। আর সেই সময় নৃত্যরত পরিদের রূপ থেকে চারদিকে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়তো। এই পাহাড়েরই নিচে ভয়ঙ্কর একটি গুহা রয়েছে।
কথিত আছে, কোনো এক সময়ে এই হিমছড়িতে এক আরব বণিকের তরী ডুবে গিয়েছিল। সেই তরীর এক যুবা পুরুষ হচ্ছেন শাহেন শাহ। তিনি ঝরনার মিষ্টি পানি পান করতে এসে হিংস্র বন্যপ্রাণীর কবলে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি দৌঁড়ে ওই গুহায় আশ্রয় নেন।

পরবর্তী এক মাঘী পূর্ণিমা রাতে পরিদের নৃত্য-গীত শুনে শাহেন শাহ গুহা থেকে বের হয়ে আসেন। তার রূপে মুগ্ধ হলেন হিমপরি। তারপর দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর প্রেম-ভালোবাসা।

এরপর একদিন শাহেন শাহকে নিয়ে হিমপরি নিরুদ্দেশ হলেন। কিন্তু ভ্রমণার্থীদের জন্য রয়ে গেল শাহেন শাহ গুহাটি।
 
দরিয়ানগরের সেই শাহেন শাহ গুহাটি  এখনও রয়েছে। তবে নেই সেই ঝরনা ও সৌন্দর্য। ৭০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের নিচে প্রায় আধা কিলোমিটার লম্বা একটি সুড়ঙ্গপথ রয়েছে দরিয়ানগরে। শাহেন শাহ-হিমপরি না থাকলেও তাদের নিদর্শন এখনও বিদ্যমান।

কক্সবাজারে ঘুরতে এসে অনেকেই শাহেন শাহ-হিমপরির সেই ভালোবাসার নিদর্শন পরিদর্শন করেন। শাহেন শাহ-হিমপরি যেমন ভালোবাসার মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন, তাদের দেখানো পথে অনেকেই প্রিয়জনকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠেন। সেখানে রয়েছে বসার জন্য একটি চালাঘর। একান্ত নির্জনে দু’জনে আপন মনে কথা বলার উপযুক্ত স্থান। প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ উপভোগ করা যায়।
ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য গুহাটি খুবই জনপ্রিয়। এজন্যই সব বয়সী মানুষ গুহাটি পরিদর্শনে আসার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। পাহাড়ের চূড়ায় মো. সুমন ও শাহজাদী আখতারকে দেখা যায়, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। নির্জন জায়গায় প্রিয়জনকে নিয়ে এসেছেন সুমন।
 
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘কক্সবাজারে এলে দরিয়ানগরে আসতে না পারলে ভালো লাগে না। এখানে একটু নির্জনে কথা বলার সুযোগ আছে, যা অন্য কোথাও নাই। আমরা দু’জন এসেছি। যদিও পাহাড় বেয়ে উঠতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তারপরও এখন ভালো লাগছে। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সাগর দেখতে পাচ্ছি’।
 
কুমিল্লা থেকে শামীমা আক্তার (৪০) দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছেন দরিয়ানগরের গুহায়।   ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন‍‍‍‍, ‘এতোদিন সিনেমায় পাহাড়ি ঝরনা ও গুহা দেখেছি। আজ নিজে চোখে দেখতে পেরে খুব ভালো লাগছে।

তার সঙ্গে থাকা জান্নাতুল ফেরদৌস  ও মাইশা বলেন, আমাদের ভালো লাগছে। তবে কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন, এখানে বসার জন্য সুব্যবস্থা নেই। এসব  জিনিসের ঠিক করলে পর্যটকদের আগ্রহ বাড়বে’।
কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে গেলে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্ব দিকে দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্র। পশ্চিমে বিশাল বঙ্গোপসাগার, পুবে উঁচু পাহাড়। মাঝখানে দিয়ে চলে গেছে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এ পথ ধরে এগিয়ে গেলে নজরে পড়বে সবুজ-শ্যামলে ভরা একটি গ্রাম, নাম তার বড়ছেড়া।

এই বড়ছেড়ার উঁচু-নিচু ৩৭ একরের বিশাল পাহাড় নিয়ে গড়ে উঠেছে পর্যটনের বিনোদন কেন্দ্র দরিয়ানগর। পাহাড়ের ঢালে সাজানো এ জায়গাটি দেখার জন্য খুবই চমৎকার স্থান।
 
দরিয়ানগরের প্রবেশপথে রয়েছে বিশাল আকৃতির হাঁ করা হাঙ্গর। এই হাঙ্গরের পেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। এরপরে পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে যেতে রয়েছে কাঠের ট্রেইল, পাহাড়ি ঝরনা ও সুড়ঙ্গপথ। কিছু দূর উপরে ওঠার পর একটি পথ চলে গেছে নিচে, আর একটি উপরের দিকে।

নিচেরটি ধরে এগোলে হাতের ডানে দেখা মিলবে ছোট্ট একটি ঝরনা। আর হাতের বা দিকেরটি ধরে নিচে নেমে গেলে পাহাড়ের সুড়ঙ্গপথ। এ পথের মাথায়ও আছে আরেকটি ঝরনা। এসব ঝরনায় এখন অবশ্য পানির স্রোত নেই।
 
তবে পাহাড় বেয়ে ১০০ ফুট ওপরে উঠলেই সামনে নীল সমুদ্র, পেছনে উঁচু-নিচু পাহাড় দেখতে পাওয়া যাবে, যা খুবই মনোমুগ্ধকর। যারা নির্জনে ঘুরতে পছন্দ করেন, তাদের জন্যই মূলত দরিয়ানগর।
দরিয়ানগরে ঘুরতে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বনের দরকার। পাহাড়ের নিচে শাহেন শাহ গুহায় প্রবেশের সময় একটু সর্তক থাকতে হয়, কেননা সরুপথ দিয়ে হাঁটার সময় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এছাড়া বর্ষার সময় উঁচু পাহাড় থেকে সাপ পড়ারও আশঙ্কা কম নয়। তবে গ্রীষ্ম ও শীতকালে গুহায় প্রবেশ অনেকটাই নিরাপদ।
জানা গেলো, বন বিভাগের তত্ত্বাবধানেই চলে দরিয়ানগর। প্রতি বছর ইজারা দেওয়া হয় এ দর্শনীয় স্থানটি। বর্তমানে এর দায়িত্বে রয়েছে কক্সবাজার সি-বিচ ক্লাব। দরিয়ানগরে প্রবেশের জন্য প্রতি টিকিটের মূল্য দেশি পর্যটকদের জন্য ৩০ টাকা। আর বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১৬০ টাকা বা দুই ডলার।

দরিয়ানগরের ম্যানেজার শাহ আলম বাংলানিউজকে জানান, ২০০৪ সাল থেকে দরিয়ানগর লিজের মাধ্যমে চলছে। বন বিভাগ এ লিজ দিয়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ দর্শনার্থী দরিয়ানগরে প্রবেশ করছেন। তবে পর্যটন মৌসুমে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ জনও প্রবেশ করেন। ‌

‘বন বিভাগ এক বছরের জন্য লিজ না দিয়ে বেশি সময়ের জন্য দিলে আরও কিছু বসার জায়গা তৈরি করা যেতো। তাছাড়া সরকারি জায়গায় আমরা তো চাইলেই কিছু করতে পারি না। এখানে কিছু ছাউনির প্রয়োজন, বসার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব করতে পারলে দরিয়ানগর আরও আকর্ষণীয় হবে। ’ যোগ করেন তিনি।

দরিয়ানগরে যাবেন কিভাবে
কক্সবাজার বাস টার্মিনাল থেকে সিএনজি চালিত অচোরিকশা, জিপ, টমটমে যাওয়া যায়। বাস টার্মিনাল থেকে অটো রিকশায় গেলে ১৫ টাকা দিয়ে কলাতলী মোড়ে নামতে হয়। এরপর কলাতলী থেকে আবার অটোতে ১৫ টাকা দিয়ে দরিয়ানগরে পৌঁছানো যায়। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় ৫০ টাকা ও ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকে ৪০ টাকা ভাড়া লাগে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৬
এসএম/এএসআর

** মেঘ এলেই মাটি লবণ খেত
** কি করে হয় লবণ চাষ
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন-সুন্দরবন ঘিরে নানা পরিকল্পনা
** প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ‘জেট স্কি’
** লাবনী-সুগন্ধা নয়, পুরো সৈকতে উপযোগী পরিবেশ দরকার
** বয়া ছাড়াই জাহাজ চলছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনে
** প্রবাল পাথরের ভাঁজে ভাঁজে মাছের খেলা
** পঁচা মাছে নষ্ট হচ্ছে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য

** দূর থেকে ভাসমান, কাছে গেলেই দৃশ্যমান ছেঁড়া দ্বীপ
** ছেঁড়া দ্বীপে যেতে অবশ্য করণীয়|
** পর্যটন নগরী‌তে বাংলা ভাষার বেহাল দশা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ