ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

পর্যটন মোটেলের সেবায় দীনতা, দেখার কেউ নেই

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
পর্যটন মোটেলের সেবায় দীনতা, দেখার কেউ নেই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কক্সবাজার পর্যটন ফিরে: সেবায় দীনতার কারণে ভ্রমণে পর্যটন মোটেলগুলো কখনই পছন্দের তালিকায় রাখ‍া যায় না। স্টাফদের আচরণ বোঝাবে, তারা থাকতে দিয়ে বড়ই কৃপা করছেন ভ্রমণকারীদের।

এজন্য তাদের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকাও উচিত বুঝি!

দু’চারটে পর্যটন মোটেল ঘুরলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, ‘মন্ত্রীর ভাইপো’ টাইপের লোকজনরা কাজ করেন এখানে। আচরণ এমন, পর্যটন করপোরেশন তাদের হাতে পায়ে ধরে এনে চাকরি দিয়েছে। আর তারা চাকরিতে থেকে ধন্য করেছেন পর্যটন করপোরেশনকে।     

চলতি বছরকে পর্যটন বছর ঘোষণা করা হয়েছে। এই বছরে ‘সর্বোচ্চ সার্ভিস’ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সেই আগ্রহ থেকেই সম্প্রতি দু’টি সফরে পর্যটন মোটেলে দিনকয়েক কাটে। কিন্তু অভিজ্ঞতা সুখকর বলা যায় না।

গত ১৯ মার্চ রংপুর পর্যটন মোটেলের অব্যবস্থাপনা দেখলেও বিষয়টিতে খুব একটা পাত্তা দেওয়ার কথা ভাবনায় আসেনি। বরং ভাবনায় আসছিল, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়তো। কিন্তু এবার কক্সবাজারের পর্যটন মোটেল শৈবাল-এ এর চেয়েও দুঃসহ অভিজ্ঞতা কি-বোর্ডে হাত দিতে বাধ্য করলো।

০৫ এপ্রিল, রাত ১০টা। রুম সার্ভিসের কর্মী মশা তাড়ানোর ওষুধ নিয়ে রুমে ঢুকলেন। সামান্য পরিমাণে স্প্রে করে চলে যাচ্ছিলেন। রাতে মশা বেড়ে যেতে পারে ভেবে ‘অ্যারোসলটি রেখে যান’ বলতেই তার উত্তর, ‘প্রয়োজন হলে আমরা স্প্রে করে নেবো। ’ এরপর খানিকটা ধমকের সুরে সার্ভিসকর্মীর বক্তব্য, ‘রুমে দিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই’।

পুরো মোটেলের জন্য মাত্র একটি অ্যারোসল রয়েছে। এটা জেনে চোখ প্রায় কপালে ওঠাতে গেলে সেই সার্ভিসকর্মী অভয় দিলেন, আবার যদি মশার উৎপাত দেখেন, তাহলে ফোন দিলেই স্প্রে করে দিয়ে যাবো। যতো রাতেই হোক সমস্যা নেই।

রাত ১টা তখন। নিউজের কাজে মগ্ন। এরমধ্যে ‍রুমে ভন ভন করে করতে থাকলো মশা। ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকলো। পায়ে ফটাফট হুল ফোটাচ্ছিল। নিউজের মনোযোগ সরে গেলো মশা নিধনে। তিনটি মশা হাতে পিষে মেরে স্বস্তি নিয়ে আবার নিউজে মনোনিবেশ। এবার যেনো ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আক্রমণ শুরু করলো।

বাধ্য হয়ে সু পায়ে দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত গামছার ‘প্রতিরোধক আবরণ‘ দিতে হলো। এরপর আবার মনোনিবেশ নিউজে। এবার মশা আক্রমণ করতে লাগলো মুখ, কাঁধ ও হাতে।

রুমে মশা প্রবেশের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো, প্রধান দরজা ও ব্যালকনিতে যাওয়ার দরজা বাঁকা হয়ে ফাঁক হয়ে রয়েছে। সেদিক দিয়ে সদলবলে মশা প্রবেশ করছে ২০৮ নম্বর কক্ষটিতে।

এই অবস্থায় আরেকবার অ্যারোসল স্প্রে করার জন্য রিসিপশনে ফোন করতেই হলো। রিং বেজেই যাচ্ছিল, কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছিল না। টানা পাঁচবার ফোন করার পর হতাশ হতে হলো। নামতে হলো মশারির সন্ধানে। আলমারি খুলতেই মশারি পেয়ে উচ্ছ্বাস কাজ করলো।

কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মশারি টানাতে গিয়ে দেখা গেলো, সেমি-ডাবল বেডের তুলনায় অনেক ছোট মশারি। ছাত্রাবাসে ব্যবহৃত মশারির মতো। তাতেও নেই লাগানোর জন্য কোনো দড়ি। মশা থেকে আত্মরক্ষার কৌশল অনুসন্ধানেই মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছিল যেনো। শেষপর্যন্ত জোড়া-তালি দিয়ে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হলো।

ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেলো। গরমে শরীর থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। এসি যথারীতি তখনও চালু রয়েছে। এসির রিমোর্টের তালাশ করে খুঁজে না পেয়ে ফ্যান চালিয়ে দিয়েই আবার ঘুমাতে হলো।

কিন্তু পরবর্তী গন্তব্য সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সূচি সকাল সকাল হওযায় ঘুমে বেশি থাকা হলো না। ভোর সাড়ে ৫টায় বেরিয়ে পড়তে হলো। রিসিপশনে গিয়ে দেখা গেলো কেউ নেই। রিসিপশনের বাইরে একজন নিরাপত্তা প্রহরী। পরে জানা গেলো, তিনিই রিসিপশনের দায়িত্বে রয়েছেন।

সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে এসির রিমোর্ট চাইলে জবাব মিললো, নেই। রিমোর্ট কি কেবল ২০৮ নম্বর রুমের এসির নেই? এমন প্রশ্নে রিসিপশনে থাকা কর্মীর উত্তর, কোনোটিরই নেই। সবগুলো এসি বৈদ্যুতিক সুইচে অফ-অন করতে হয়।

বিকেলে তাড়া থাকায় হোটেল বয়কে নিজের লাগেজ রুমে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলে তিনি উত্তর দিলেন, স্যার আমার ডিউটি শেষ। আমি রিসিপশনে রেখে দিতে পারি। পরের শিফটের লোককে বলে যাবো পৌঁছে দিতে।

কিন্তু রাত ১০টায় রুমে ফিরে লাগেজ না পেয়ে কয়েক দফায় ফোন করেও সাড়া মিললো না। পরে নিজে গিয়েই লাগেজ আনতে হলো। অথচ বেসরকারি কোনো হোটেল-মোটেলে কেউ গেলে তার হাত থেকে দারুণ আগ্রহে ব্যাগ নিয়ে রুমে পৌঁছে দেওয়া হয়।

এর আগে, ১৯ মার্চ রংপুর ভ্রমণ হয়েছিলো। সেখানে উঠেছিলেন একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। রাত ৮টায় মশা গিজগিজ করছিল রুমটিতে। সেসময় অ্যারোসল দিতে বলা হলে মিনিটবিশেক পরে দেখা মেলে সার্ভিসকর্মীর।

রুমটিতে অ্যারোসল রেখে যেতে বলা হলে একই জবাব মিলেছিল। পুরো মোটেলের জন্যই একটি অ্যারোসল বরাদ্দ। সেটাই তারা ঘুরে ঘুরে স্প্রে করেন। তাই নির্দিষ্ট কোনো রুমে রেখে দেওয়া সম্ভব নয়।

সেই জবাব বেশ অবাক করেছিল। ওইসব রুমে সাধারণত ভিভিআইপিরা থাকেন। সেরকম একটি রুমেও কি স্থায়ীভাবে অ্যারোসল রেখে দেওয়া যায় না?

এসব বিষয়ে ন্যাশনাল হোটেল ট্যুরিস্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ পারভেজ আহমেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলছিলেন, এমন কিছু হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ম্যানেজার দায়ী। অ্যারোসল রুমে রাখবে না-কি স্প্রে করে দিয়ে আসবে সেটিও তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে ডেলিগেট যতোবার মশার ওষুধ স্প্রে করতে বলবেন ততোবার স্প্রে করতে বাধ্য কর্তৃপক্ষ।

এমন চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যেও মুগ্ধ করবে পর্যটন মোটেল শৈবালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ব্যালকনি ছুঁই ছুঁই বিশাল বাগানবিলাস। বাগানে ফুটন্ত নানান জাতের গোলাপ। চারপাশের পুকুরে বাতাসে পদ্মফুলের দোল। কয়েক মিনিট হাঁটলেই সমুদ্র সৈকত। রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সাগরের স্পষ্ট গর্জন। পাশে সুইমিং কমপ্লেক্স। বিশাল বড় রেস্টুরেন্ট।

এই সৌন্দর্যের গুণ বিচারে যে কেউই বলবেন, কেবল সার্ভিসে ‘দায়িত্বহীনতা’ই এগোতে দিচ্ছে না পর্যটন করপোরেশনের মোটেলটিকে।

কক্সবাজার ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান মিল্কি ‘ভাঙা পড়বে শৈবাল, গড়া হবে ফাইভ স্টার’ শিরোনামে বাংলানিউজের একটি নিউজে মন্তব্য করেন, ওনাদের (পর্যটনের) সঙ্গে কথা বলতে খারাপ লাগে। এমন গোমড়া মুখ করে বসে থাকেন। মনে হয় কোনোকিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে অপরাধ করেছি। শুধু শৈবাল নয় প্রবালেও একই অবস্থা।

এ নিয়ে কক্সবাজারের এনজিও কর্মী সবুজের মন্তব্য, ম্যানেজমেন্ট অনেক বেশি ভালো করা দরকার।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
এসআই/এমজেএফ/এইচএ/এসএনএস

**পুরুষ যায় মসজিদে, নারীদের জায়গা নেই
** সেন্টমার্টিন দেখতে কেমন (পর্ব-২)
**সেন্টমার্টিন দেখতে কেমন (পর্ব-১)
** কুকুর যখন ‘টুনা’ শিকারি
** ‘পর্যটন মৌসুম শব্দটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে’
** তৈরি হচ্ছে ‘বিচ ডাটাবেজ’
** সেন্টমার্টিনে সৈকত জুড়ে কাঁকড়ার আল্পনা
** সেন্টমার্টিনে বাজার সদাইয়ের সংগ্রাম (ভিডিওসহ)
** সৈকতের আল্পনাশিল্পীদের করুণ মৃত্যুগাথা
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ