ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

লোকবল সঙ্কটে ধুঁকছে সেন্টমার্টিনের কাছিম সংরক্ষণ কার্যক্রম

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৬
লোকবল সঙ্কটে ধুঁকছে সেন্টমার্টিনের কাছিম সংরক্ষণ কার্যক্রম ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে: আগেই জানা ছিলো, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে একটি ‘মেরিন পার্ক’ রয়েছে। সেখানে ‘সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ কার্যক্রম’ চলে।

এও জানা, পার্কটির অবস্থান দ্বীপের দক্ষিণ অথাৎ ‘গলাচিপা’ গ্রামে। বৃত্তাকার দ্বীপ প্রদক্ষিণের অংশ হিসেবে সেখানেও যাওয়া হলো কিন্তু মেরিন পার্কের দেখা নেই! 
দুপুর গড়িয়েছে। ততোক্ষণে গলাচিপার ‘চিপা’ (সরু) রাস্তা দিয়ে পশ্চিম পাশে চলে গেছি। হঠাৎ সহকর্মীর খবর, মেরিন পার্ক পাওয়া গেছে! বেশতো, যাওয়া যাক। ওই একই চিপা দিয়ে হাতের ডানে আরেকটি সরু গলি- একটু যেতেই বামদিকে পার্ক। আরে, এই পথ দিয়েই তো গেলাম- চোখেই পড়লো না!
গেটের বামদিকে মেরিন পার্কের সাইনবোর্ড, ডানদিকে বোর্ড কাছিম সংরক্ষণ কার্যক্রমের। প্রথমে মনে হলো, গেট বুঝি বন্ধ। একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেলো। অভিধানের ‘জনমানবহীন’ ও ‘শ্মশানপুরী’ শব্দ দু’টোই বোধহয় মেরিন পার্কের জন্য যথাযথ!
ঢুকেই ডানদিকে ঘিয়েরঙা একতলা ভবন। উঁকি দিলাম, বন্ধ। চোখ চলে যায় গোটা চত্বরজুড়ে। হাঁটু অব্দি কাশ আর নারকেল গাছে ভর্তি। গাছ ছোট তাই নারকেল পাতা মাটি ছুঁয়েছে। পাতাগুলো নিয়মিত না ছেঁটে দিলে যা হয়- স্বাভাবিকভাবে চলতে-ফিরতে বাধা সৃষ্টি করে।
একটু দূরেই কাছিম সংরক্ষণ কার্যক্রমের ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ও হ্যাচারী’। সেখানেও যাওয়া হলো, খালি। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ধরলাম নির্দেশিত চলার পথ। পথের পাশেই পরপর দু’টি একতলা ভবন, সেখানেও তালা মারা। খোলা জানালা আরেকটু খুলে উঁকি দিতে সংরক্ষিত সাপ অন্য সামুদ্রিক প্রাণী নজরে এলো। পথ ধরে একেবারে শেষমাথাও যাওয়া হলো, সেখানেও শ্মশানপুরী। এদিক-ওদিক দেখে কোনো কার্যক্রম বা কারও দেখা না পেয়ে হঠাৎ খেয়াল হলো, আজ ছুটির দিন নয়তো? নাহ, পূর্ণ কর্মদিবস।
বেরিয়ে যেতে যেতে ইটবাঁধাই একটি চত্তরে দু’টি মানুষের দেখা। যাক, ‘জনমানবহীন’ শব্দ থেকে অন্তত রেহাই পেলো! দু’জনই জাল বুনছিলেন। একজন নারী ও একজন পুরুষ। পুরুষটির নাম নুর হোসেন। বয়স বাষট্টি। পেশায় জেলে। পার্কের পাশেই বাড়ি।  

চাচা, কেউ নেই এখানে? (উত্তর এলো আধা প্রমিত ও পুরো চাঁটগাইয়া অ্যাকসেন্টে)
‘না, কক্সবাজার গেছে। ’
কে গেছে?
আজিজ। এসব দেখাশোনা করে।
তিনি এখানকার কে?
‘কেয়ারটেকার’।
আর কেউ নেই?
‘না’।
ওনার মোবাইল নম্বর আছে আপনার কাছে?
‘না। এখানে আরেকজন আছে, তার কাছে আছে। (ইশারায় নেই শেষের বাড়িটি দেখালেন। ’
গেলাম তো একটু আগে, কাওকে দেখলাম না!
‘আছে ভেতরে’।
অনুরোধ করলে নিয়ে গেলেন সেখানে। কয়েকবার চিৎকার ও দরজা ধাক্কানোর পর খালি গায়ে দরজা খুললেন প্রায় বছর পঁয়ত্রিশের জোবায়ের। নাম পরে জানা গেছে। জানালেন, তিনি অসুস্থ। সম্পর্কে তিনি আজিজের মামা। দীর্ঘদিন পরিবেশ অধিদফতরে কাজ করেছেন, এজন্য কর্তৃপক্ষ তাকে এখানে থাকতে বলেছেন।
যাইহোক, তার কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নেওয়া হলো মোহাম্মদ আবদুল আজিজের। পরে কথা বলে নেওয়া যাবে।  
 
এদিকে, বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, কচ্ছপের বয়স ও আকার অনুসারে ডিম-ধারণ ক্ষমতার তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত এদের ডিম ধারণ ক্ষমতা দুই থেকে ২০টি পর্যন্ত হয়। তবে সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজাতিরা এর চেয়ে অনেক বেশি ডিম দেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কচ্ছপের ডিম-ধারণের ক্ষমতা বাড়ে। কচ্ছপ জলাশয়ের পাড়ে ডাঙায় ও সৈকতে এসে ডিম দেয়। ডিম দেওয়ার আগে স্ত্রী কচ্ছপ পিছনের পা দিয়ে নরম মাটি বা বালিতে গর্ত করে প্রতিটি গর্তে একটি করে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়া শেষ হলে সংরক্ষণের জন্য স্ত্রী কচ্ছপ মাটি দিয়ে ডিম ঢেকে রাখে। কচ্ছপের ডিম গোলাকার থেকে শুরু করে ক্যাপসুল আকারের হয়। ডিমের খোলস অত্যন্ত শক্ত ও সাদা বর্ণের। কচ্ছপের প্রজনন সাফল্য, তথা ডিম পরিস্ফুটনের হার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন- মাটিতে তাপমাত্রা, চাপ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। ডিম ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত গরম বা শীতে ডিম নষ্ট হয়ে যায়।  
এক ফাঁকে কথা হয় আবদুল আজিজের সঙ্গে। পার্ক ঘুরে উল্লিখিত প্রতিক্রিয়া জানালে বললেন- হ্যাঁ, আমি এই পার্কের কেয়ারটেকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। হ্যাচারি সংশ্লিষ্ট কাজেই কক্সবাজার গিয়েছিলাম। আগস্ট থেকে মে মাস পর্যন্ত সিজন। এখন শেষের দিকে। হ্যাচারি আসলে খালি নয়, ওখানে বালির নিচে ডিম রাখা। এজন্য দেখতে পাননি। আমি থাকলে দেখাতাম। মার্চের শেষ পর্যন্ত ১২শ ডিম ছিলো। এপ্রিলের শুরুর দিকে প্রায় ছয়-সাতশো কচ্ছপ সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিম ফুটতে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ দিন লেগে যায়।
 সেন্টমার্টিনে কোন কোন প্রজাতির কচ্ছপ দেখা যায়? ‘এখানে গ্রিন টার্টল আর অলিভ রিডলে নামে কচ্ছপ বেশি দেখা যায়। গ্রিন টার্টল এক মৌসুমে ৫০ থেকে ১০০টি ডিম দেয়। অলিভ রিডলে দেয় ৮৫ থেকে ১৫০টি। হজবিল নামেও একটি প্রজাতি পাওয়া যায়। কিন্তু আগের তুলনায় প্রতি মৌসুমে ডিম পাওয়ার হার কমছে। ২০১৫ সালের মৌসুমে প্রায় ২০০০ ডিম পেয়েছিলাম। এই মৌসুমে পেয়েছি ১২০০।

কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, ডিম দেওয়ার মৌসুমে কচ্ছপ সৈকতের কাছাকাছি আসে। এ অঞ্চলে সাধারণ জেলেরা মাছ ধরে। তাদের ছোট ছিদ্রওয়ালা জালের কারণে অসংখ্য কচ্ছপ মারা যায়। এছাড়া সৈকতজুড়ে ব্যস্ততা বেড়েছে। বেশি ভিড় ও শব্দ পেলে কচ্ছপরা ভয় পেয়ে আর ডিম ছাড়তে সৈকতে ওঠে না। এসব সমস্যা নিয়ে মেরিন পার্ক ও বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে।  

কিন্তু মেরিন পার্কের যে হাল তাতে এ উদ্যোগ কতোটা ফলপ্রসূ হচ্ছে? এ নিয়ে দ্বিগুণ হতাশা ঝরে পড়লো আজিজের কণ্ঠেও, আমি একাই এই পার্ক দেখেশুনে রাখছি। দশজনের কাজ একজনে করি। রাতে থাকা ও বিভিন্ন কাজে তাই জোবায়েরকে রেখেছি। সম্পর্কে আমার মামা হয়। আমি বহুবার অধিদফতরের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি যে, আপনারা লোকবল বাড়ান। আমি একা সব বিষয় কীভাবে সামলাবো! কদিন আগে মন্ত্রীর স্ত্রী ঘুরে গেছেন, তাকেও বলেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, এ বিষয়ে জানাবেন। আপনি সাংবাদিক, দেখেন এ নিয়ে লিখে যদি কিছু হয়। আপনারা সেন্টমার্টিনের জন্য কিছু করেন। এভাবে চলতে থাকলে এখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।     

বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ