ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

লাউয়াছড়া গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া আসে

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
লাউয়াছড়া গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া আসে ছবি: শুভ্রনীল সাগর

লাউয়াছড়া (শ্রীমঙ্গল) থেকে: ‘অনন্যমনা হইয়া প্রকৃতিকে লইয়া ডুবিয়া থাকো, তাঁর সর্ববিধ আনন্দের বর, সৌন্দর্যের বর, অপূর্ব শান্তির বর তোমার উপর অজস্রধারে এত বর্ষিত হইবে, তুমি দেখিয়া পাগল হইয়া উঠিবে, দিনরাত মোহিনী প্রকৃতিরানী তোমাকে শতরূপে মুগ্ধ করিবেন, নূতন দৃষ্টি জাগ্রত করিয়া তুলিবেন, মনের আয়ু বাড়াইয়া দিবেন, অমরলোকের আভাসে অমরত্বের প্রান্তে উপনীত করাইবেন। ’

খুব চেনা-চেনা লাগছে লাইনগুলো? ঠিক ধরেছেন, আরণ্যক! মায়েস্ত্রো বিভূতিভূষণ একদা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের দক্ষিণ ভাগলপুর ও গয়া জেলার বন-পাহাড়ের অমরত্বে।

কুশী নদীর অন্যপারে তার ঠিকানা। উত্তরপুরুষের দায় থেকে পথ চিনে আমাদেরও আসতে হলো অরণ্যের দিনরাত্রে। তবে এ অরণ্য মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিন ইউনিয়ন, কমলগঞ্জ-রহিমপুর-মাধবপুর এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলপুর ইউনিয়নের মধ্যবর্তী সংরক্ষিত অংশে; নাম, লাউয়াছড়া। স্থান-কাল-পাত্রে কী যায় আসে, অরণ্যের ধর্ম সবখানে এক। এও বন-পাহাড়ি মায়ালোক, তাই মিলও অনেক।

আষাঢ়স্য শেষ দিবসের সূয্যিমামা ঝকঝকে হাসিতে পথ দেখিয়ে চলেছেন। গাঢ় নীলের ওপর সাদা সুতোর কাজ করা জামায় আজ বড্ড মানিয়েছে তাকে। চারদিকে ছড়ানো কাঁচা সোনার মতো রোদ। বালু মিশ্রিত লাল দোআঁশের টানে টানে ঢুকতেই হলো বনে। বলা ভালো, ঘন বন।

খানিকটা পথ ইটের। এই আলোছায়া পরিবেশে এমন রূপ নিয়েছে, যেনো জীবনানন্দের প্রস্তরযুগের ইট সব। লালমাটির প্রেমে এখানে এসে বুক পেতে দিয়েছে। ইট পেরোলে মাটির প্রেমিক এবার ঝরাপাতা। এক নয়, দুই নয়, অগুনতি ঝরাদিনের কাব্য। ক্রমশ সরু হয়ে আসা বনপথের দু’ধার ঘেঁষে কালো পিঁপড়ার সারি। দলবেঁধে কোথা যায় তারা? এ কথা শুধালাম জগডুমুরের ডালকে। তারা দেখিয়ে দেয়, অজানা-অচেনা ফুল-লতা আর প্রজাপতিকে। তারা ইশারা করে আরও আরও গহীন ও নিজর্নতা।

পথচলতে নবীন-প্রবীণ বৃক্ষদের সঙ্গে কথা হয়। পৃথিবীর আদিম পাহারাদার এ পরম বন্ধুদের অদ্ভুত এক সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে। গভীর বিষাদের অস্ফুট ইশারা নিয়ে তাকিয়ে থাকে, তাতে লাখো-কোটি না বলা শব্দ। কেমন নাড়িয়ে দেয় বুকের ভেতরটা। হঠাৎ মগজের ধূসর অঞ্চল থেকে পূর্বপুরুষের স্মৃতি এসে হানা দেয়। মনে হয়, তারা কেউ গাছ কিংবা পাখি হয়ে রয়ে গেছে। ডলু বাঁশের ফিসফিস উচ্চারণ কানে এসে বলে যায়, তোমাকে তো চিনেছি ভাই। মনে নেই? একসময় তোমাদের আদিপিতারা আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতো। এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে সব!

যতো পা এগোয় ততো আলো কমে আসে। ময়না, ধনেশ, টিয়ার কলতান আরও অর্থবহ হয়ে কর্ণমন্দিরে ঘণ্টা বাজায়। বহুদিন পর প্রিয়জন বাড়িতে এলে যেমন শাঁখধ্বনি বেজে ওঠে, তেমনি করে কি ডেকে উঠলো সবুজ ঘুঘু-মথুরা? হরিণ, শূকর, উল্লুখ, হনুমান, উল্টোলেজি বানর, চশমাপরা হনুমানদের আজ যেনো বড় আনন্দ। দেখা দেয় না, কিন্তু পাতা-লতা-ডালের ফাঁক দিয়ে উল্লাস-হুল্লোড় ঠিকই চলে।

 

হঠাৎ হঠাৎ বিপুল বিস্ময়ের মতো দেখ দেয় সুদৃশ্য বুনো ছড়া। স্বচ্ছ পানির নিচে বালি-মাটি দেখা যায় পরিষ্কার। ছোটমাছের ঝাঁক এই এখানে তো চোখের পলকে অন্যখানে। ছড়াগুলো ঢুকেছে বনের আরও গভীরে। সেখানে আমাদের ইচ্ছারূপী কাগজের নৌকাগুলো পৌঁছে যায়। এদিকে, পায়ের পাতা পেরিয়ে যায় চা বাগান, লেবু ক্ষেত, আরও কতো কী!

বন বিভাগের তথ্য জানাচ্ছে, ১২৫০ হেক্টরের চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরহরিৎ এই বনে দীর্ঘমেয়াদী বড় বৃক্ষ, মধ্যম শ্রেণির উদ্ভিদ জাতীয় গুল্ম, ঝোপঝাড়, স্বল্পমেয়াদী বাঁশ ও বেত প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এছাড়া প্রায় ১৬৭ প্রজাতির গাছ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতীর সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৪৬ প্রজাতির পাখিসহ শতাধিক প্রজাতির প্রজাপতি ও কীটপতঙ্গ এখানে দেখা মেলে।

১শ থেকে ৩শ উচ্চতার পাহাড়বেষ্টিত এ বনভূমিতে আগর, আফ্রিকান টিকওক, শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন, চালকুমড়া, অয়েলপাম ইত্যাদি বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে। রয়েছে সেগুন, জারুল, চাপালিশ, চম্পাফুল, কড়ই, চিকরাশি, মেহগনি, শাল, জাম, আকাশমণি, অর্জুন ইত্যাদি। এককথায়, জীববৈচিত্র্যের আধার এই বন।

লেবুক্ষেতে ছিলাম। বন থেকে বেরিয়ে মানুষের আনাগোনা দেখতে পেয়ে মনুষ্যসৃষ্ট তথ্যের কথা মনে হলো। লোকাল বাসগুলোতে লেখা থাকে, কিছু ফেলে গেলেন কি? এবার আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত বৃহদাকার প্রশ্নচিহ্ন সামনে হাজির হয়। সেইসঙ্গে একপ্রকার অতল-সমাহিত অতিমানস চেতনা। মানসপটে লাউয়াছড়া হাজির হয় এক অন্যমূর্তির রূপ ধরে। তাকে চেনার চেষ্টা করি। এ দায় বাকি উত্তরপুরুষদেরও। রাজধানী থেকে সোজা শ্রীমঙ্গল সদর, সেখান থেকে আট কিমি দূরে এই অমৃতলোক, অতিমানস চেতনা ও অন্যমূর্তি।

প্রণম্য বিভূতির লাইন দিয়ে শুরু হয়েছিল। শেষও তাকে দিয়েই হোক। আরণ্যকের চরিত্র জয়পালকে গল্পকথক জিজ্ঞেস করছেন, ‘এই যে একা এখানে (বন-পাহাড়ে) থাক, কারো সঙ্গে কথা বলো না, কোথাও যাও না, কিছু করও না- এ ভালো লাগে? একঘেয়ে লাগে না?’ নগরের আলো-বাতাস না-দেখা জয়পাল; জীবনের স্বাভাবিক বিশাল আনন্দরূপ না-দেখা জয়পাল, যার কাছে জীবনের অন্য কোনো ধারণা নিরর্থক, কম্পনহীন গলায় জানায়- ‘কেন খারাপ লাগবে হুজুর? বেশ থাকি। কিছু খারাপ লাগে না। ’

*** ‘সবাই বন্যপ্রাণী এনজয় করে কিন্তু তাদের কথা ভাবতে চায় না’

*** ওদের ট্রেন, মোদের ট্রেন

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
এসএনএস/টিআই

    

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ