ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ভোরের স্নিগ্ধ লাউয়াছড়া-১

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
ভোরের স্নিগ্ধ লাউয়াছড়া-১ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান (শ্রীমঙ্গল) থেকে: রাত তিনটায় বাংলোতে ফেরার পথে বন কর্মীরাই জানালেন, ভোরে লাউয়াছড়ার মোহনীয় রূপের কথা। তখন এখানে নাকি অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণীকে দেখতে পাওয়া যায়।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বনের গহীনে চলে সে সব প্রাণীরা।  

কারণ ব্যাখ্যা করলেন সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) তবিবুর রহমান। তার মতে, এখানে অনেকেই আসেন পিকনিক করতে। এসেই হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন। আর প্রাণীগুলো ভয়ে বনের গহীনে চলে যায়। কারোরই ‍মাথায় থাকে না প্রাণীগুলোর কথা। কেউ কেউ তো বাঁশি-গিটার নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে উচ্চ শব্দে বাজাতে শুরু করেন।

সিদ্ধান্ত হল ভোর সাড়ে ৫টায় বের হওয়ার বিষয়ে। সালাম জানিয়ে রাতের মতো বিদায় নিলেন এফজি (ফরেস্ট গার্ড) জহিরুল ইসলাম। দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভোরে যথা সময়ে তিনি আসবেন কি-না, এ নিয়ে সংশয় থেকেই গেলো।

ভোর পাঁচটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে দরজা খুলতেই সালাম দিয়ে উপস্থিতি জানান দিলেন জহিরুল ইসলাম। কাঁধে এক নলা বন্দুক ঝোলানো। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অনুশোচনা হচ্ছিল। সময়ানুবর্তী লোকটি সম্পর্কে কী ধারণা ছিল তা ভেবে।

বেশ কয়েকটি ট্রেইল (পায়ে হাঁটার পথ) রয়েছে, আমি কোনটিতে যেতে চাই জানতে চাইলেন তিনি। বললাম, খাসিয়া পল্লী ও লেবু বাগান দেখা যাবে এমন ট্রেইলে যেতে চাই। বললেন, এইটা পৌনে এক ঘণ্টার ট্রেইল। তবে লেবু ও খাসিয়া পল্লীতে যেতে হলে প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটতে হবে। সমস্যা নেই জানাতেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। আমিও তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম।

অনেকগুলো টিলার সমন্বয়ে গঠিত লাউয়াছড়া। আর বন বিভাগের বাংলোটি তারই একটি টিলার চূড়ায় অবস্থিত। চারদিকে গাছালিতে ভরা। একটি পিচঢালা সড়ক টিলার গায়ে বাঁক নিয়ে নিচে রেললাইনে (ঢাকা-সিলেট রুট) গিয়ে ঠেকেছে। রেল লাইনটি টিলার মাঝামাঝি উচ্চতায় নির্মিত। সেখান থেকে একটি সড়ক ভানুগাছ সড়কে গিয়ে মিশেছে। যা বাংলোতে যাতায়াতের প্রধান সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।  

রেললাইন থেকে ভানুগাছ সড়ক পর্যন্ত গ্রামের রাস্তার মতো সড়কটি দুই পার্শ্বে তিন ফুট করে হেডিং বন্ড। আর মাঝে কয়েকফুট রয়েছে মেঠো পথ। রেললাইন পার না হয়ে বামে বাঁক নিয়ে নিচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ট্রেইলটি খানিকটা পাহাড়ের গা বেড়ে নিচে নামার সড়কের মতো।

রাতে ছিল গা ছম-ছম লাউড়াছড়া। হুতুম পেঁচার ফোসফোসানি শব্দ, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, হরিণের ডাক আর নানান রকম শব্দের তান। সকালের চিত্র ঠিক বিপরীত। রাতের হালকা বৃষ্টিতে স্নান করা লতাগুল্মগুলো বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার হাতছানি দিচ্ছিল।  

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে প্রশান্ত মনে যখন পা চালাচ্ছিলাম, তখন কানে ভেসে আসছিলো হাজারো পাখির কলতান। ট্রেইলটি দু’টি টিলার মধ্যে দিয়ে ধনুকের মতো বাঁক নিয়ে নিচে নেমে গেছে। ঝরে পড়া পার্শ্বের টিলার একটি বিশাল গাছ বাংলো টিলার উপর গিয়ে ঠেকেছে। দেখতে খানিকটা সাঁকোর মতো লাগছে।

নিচ দিয়ে হাঁটার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁকা রয়েছে। একটি বানর বাচ্চা কোলে করে গাছের ওপর দিয়ে কয়েক লাফে বাংলো টিলা থেকে পার্শ্বের টিলার চলে গেলো। পার হয়ে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খানিকটা ভেংচি কাটলো।  

সেদিকে নজর না দিয়ে কয়েক গজ এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল ঘুঘুর ঝাঁক। ট্রেইলে কি যেন কুটে কুটে খাচ্ছিল তখন। কিন্তু আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে উড়াল দিয়ে উঁচু চাপালিশ গাছে গিয়ে বসলো।  

গাছগুলো এতো উঁচু সচরাচর এমন উঁচু গাছ আমি আর কোথাও দেখিনি। আমি যে বাংলাদেশের বন ঘুরেছি এমন কিন্তু নয়। শুধু চাপালিশ নয়, একই সারিতে থাকা জাতীয় ফল কাঁঠাল গাছও যেন আকাশ পানে ছোটার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

বিশাল বিশাল বাঁশঝাড়গুলোকেও বলছে আপাতত দূরে থাক। দৌড় প্রতিযোগিতায় অনেক পেছনে থাকা প্রতিযোগির মতো অবস্থা উচ্চ-বংশীয় (লম্বা প্রজাতির) জাই বাঁশের। চাপালিশ এমনকি ধুপ গাছেরও কোমরের কাছে গিয়ে আর এগোতে পারছে না। খুব পেছনে থাকা প্রতিযোগীর মতো কতগুলো আবার রণে ভঙ্গ দিয়ে যেন মাটির সঙ্গে গিয়ে মিশেছে।  

শাল গাছ, আগর গাছও দমবার পাত্র নয়। তারাও চাপালিশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মত্ত।  জহিরুল ইসলাম বললেন, বাশের মধ্যে জাইবাঁশ সবচেয়ে লম্বা হয়। একেকটি বাঁশ ৭০ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সেই বাঁশ যখন কোমরের নিচে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে, তখন সহজেই অনুমেয় চাপালিশ কত লম্বা।  

পথে বিরল প্রজাতির চশমা পরা হনুমানের কার্যলাপ, একসঙ্গে উল্লুকের আশপাশ কাঁপানো চিৎকার, ত্রিশ খাসিয়া পল্লী জানতে চোখ রাখুন বাংলানিউজে।


বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
এসআই/এইচএ/

**লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা
**হ-য-ব-র-ল বগিতে ভোগান্তির পারাবত!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ