ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

তপ্ত জলে মিশে রয়েছে নির্মাইয়ের কান্না

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
তপ্ত জলে মিশে রয়েছে নির্মাইয়ের কান্না ছবি: বাদল-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে: সিন্দুরখান রোডের পূর্ব ঘেঁষে শ’তিনেক মিটার এগুলে বিশালায়তন এক পুকুর। আষাঢ়ের শেষ দিনে বিকেল ৪টাতেও মাথার ওপরে যেনো আগুন ঢালছে সূয্যিমামা।

তাতে তেতে রয়েছে পুকুরের পানিও। তবে সারি সারি গাছের নিচে সবুজ ঘাসে ছা্ওয়া পুকুর পাড়ে বেয়াড়া বাতাসের শীতল আদর মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিলো।

এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটু এগুলেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। সোজা দক্ষিণে সীমান্ত ইউনিয়ন সিন্দুরখান। উত্তরে শ্রীমঙ্গল শহর। পূর্ব দিকে কমলগঞ্জ উপজেলা আর পশ্চিম দিকে রশিদপুর। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে পাক্কা ১শ টাকা সিএনজি ভাড়া লাগে এখানে আসতে।

পুকুরের পশ্চিম পাড়ের মাঝামাঝিতে বাঁধানো ঘাটের কাছে নির্মাই শিববাড়ি। হাল আমলের ঝা চকচকে নতুন ভবন দেখে বুঝে ওঠারাই জো নেই যে, মিথাশ্রয়ী কী ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে এখানে! মন্দিরের নতুন ভবন আর পুকুরে মাঝামাঝিতে দু’-একটা পুরনো স্থাপনা থাকলেও সেগুলো যে খুব পুরনো নয় তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না।    

অথচ বালিশিরা পরগনার শঙ্করসেনা গ্রামের এই স্থানটিতেই ৫৬২ বছর আগে ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় নির্মাই শিববাড়ী।

চতুর্দশ শতাব্দীতে বালিশিরা অঞ্চলে ছিলো কুকিদের বসবাস। কিন্তু তাদের সামন্ত রাজার ওপর রাজত্ব করতেন প্রবল শক্তিশালী ত্রিপুরার মহারাজ। সাধ্যে না কুলালেও ত্রিপুরার মহারাজার বিরুদ্ধে প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন 'কুকি' সামন্তরাজা। ত্রিপুরার মহারাজা সেনাদল পাঠিয়ে শক্ত হাতে দমন করতেন সেই বিদ্রোহ।

এমনই এক বিদ্রোহ দমনে একবার নিজের প্রধান সেনাপতি ও জামাতাকে পাঠান মহারাজা। সেই সেনাদলের সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু হয় কুকি বাহনীর। বরাবরের মতো সেবারও পরাজিত হয় কুকিরা। তবে তাদের মরণ কামড়ে রণক্ষেত্রেই নিহত হন ত্রিপুরা মহারাজার প্রধান সেনাপতি ও জামাতা।

বিয়ের অল্প ক’বছরের মধ্যেই স্বামীহারা হন মহারাজা কন্যা নির্মাই। ভারতবর্ষে তখন সহমরণ প্রথার চল। নির্মাইয়ের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হলো না। সদ্য প্রয়াত স্বামীর সঙ্গে সহমরণের আয়োজন শুরু হলো রাজমহলে।

কিন্তু বেঁকে বসলেন নির্মাই। সহমরণে রাজি হলেন না তিনি। সুযোগ বুঝে ছোট বোন উর্মাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন রাজমহল ছেড়ে। স্বামী যেখানে নিহত হয়েছিলেন সেখানে এসে শুরু করলেন শিবের আরাধনা। নির্মাইয়ের নামেই শিববাড়ীর নামকরণ করা হলো, নির্মাই শিববাড়ি।

বিশাল পুকুরের কোণায় কোণায় মিশে রয়েছে তার হাহাকার। আষাঢ়ের শেষ বিকেলের ভ্যাপসা গরমে শিববাড়ির পেছনে ফুটবল খেলছে ক’জন উদোম গায়ের শিশু। পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় গড়ে তোলা কালিমন্দিরের বয়সও নেহায়েত কম হলো না। তার পেছনে বর্গাগার ঘন বেতবনে গা ছমছমে অন্ধকার।

বেতবনের পেছনে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেতে ধানের হাঁসি। ধানক্ষেতের বুক চিরে মাথার সিঁথির মতো এগিয়ে গেছে মেঠোপথ। মাঠের ওপাশে ত্রিপুরার আকাশ কালো হয়ে রয়েছে টলোমলো মেঘে। বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে আসা বাতাসে বৃষ্টির বারতা। এই বুঝি ঝেঁপে এলো বৃষ্টি।

মাত্র কয়েক মিনিটের পথ পেরিয়ে সিন্দুরখানগামী শিববাড়ি বাজারে আসতে না আসতেই কালো মেঘের চাদর এসে ছড়িয়ে গেলো শঙ্করসেনার আকাশে। একটু আগের প্রখর রোদ তো বটেই, আলোটুকুও যেনো লুকিয়ে পড়লো জল টলোটলো মেঘের আড়ালে।

শিগগিরই আকাশ গলে বৃষ্টি হয়ে পড়তে শুরু করলো। চা, শীত আর সবুজের পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল যে বৃষ্টিরও রাজ্য সেটাই বুঝি স্পষ্ট হলো এবার। বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ২৩০০ মিলিমিটার। আর শ্রীমঙ্গলে এই হার দ্বিগুণেরও বেশি।

বাজারে রাস্তার পাশে সাজিয়ে বসা ছোট ছোট বুনো কলা, কাঁঠাল, জাম্বুরা, ছোট ছোট দেশি পেয়ারাগুলো ভিজছে। সঙ্গে ভিজছে আশপাশের জমি থেকে তোলা পুদিনা পাতা, বরবটি, লাউ।

তবে পান-সুপারির দোকানে জাগ দেওয়া সুপারির রঙ দেখে দোকানিকে চেপে ধরতেই জানালেন, শুধু জাগের রঙ নয় ওটা, সত্যিকারের রঙেই রাঙানো হয়েছে সুপারিগুলোকে।


** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে

বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
জেডএম/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ