ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫২ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৬
বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে ছবি: আবু বকর সিদ্দিকী

লাউয়াছড়া (শ্রীমঙ্গল) থেকে: গতকাল দুপুরে তো এখানেই ছিলো মুন্নী। ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়েছিলো বাবা-মার সঙ্গে হাঁটতে থাকা এক শিশুর হাতের চিপসের প্যাকেট।

অথচো তখনো তার বুকের সঙ্গে কি এক অদ্ভূত কায়দায় নিজের বাচ্চাটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে।

বন বিভাগের কর্মীরা আদর করে মুন্নী নাম দিয়েছে মা বানরটার। কেমন মায়া মায়া চোখ, মুখাবয়বে মানুষের সঙ্গে মেশার প্রবল আকুতি। মানুষের সঙ্গে মেশার এই আগ্রহটাই সমাজ চ্যুত করে দিয়েছে তাকে। মানুষ ঘেঁষা বলে তাকে এখন দলে ভিঁড়তে দেয় না বুনো বানরের দল। মুন্নী তাই বাচ্চা সমেত সবসময় মানুষের আশেপাশেই ঘোরে।

একা চলে, একা খায়। তবু মানুষ নয়, সগোত্রীয় বানরদেরই সঙ্গে যেনো আাঁড়ি তার। কিন্তু মুন্নীকে আজ আর দেখা গেলো না। এমনকি গতকাল বিকেলে ফরেস্ট বাংলোর বারান্দায় বাচ্চা কোলো ঝিমুতে থাকা সেই বানরটিও আসেনি আজ। দেখা দেয়নি উড়ন্ত আর কালো কাঠবিড়ালি।

মুন্নীর খোঁজে এদিক ওদিক তাকিয়ে নেমে যেতে হলো বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের ভেতরে। আধা পাকা রাস্তা পেরিয়ে এবার নিরেট মাটি। দু’পাশে পাল্লা দিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে নানা জাতি-প্রজাতির গাছ। শত বছর আগে এখানে চাপালিশ, গর্জন, রক্তন গাছ রোপন করেছিলো ব্রিটিশরা।

একশ’ বছরের ব্যবধানে সে গাছগুলোই এখন আকাশ ছোঁয়া। তার সঙ্গে মিলে দেশি আর চাম কাঁঠাল গাছগুলোও অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে উঠেছে স র্যের আলো পাওয়ার প্রতিযোগিতায়। এতো লম্বা কাঁছাল, রাবার গাছ দেশের আর কোথাও আছে কি না কে জানে। এখানকার শালগাছগুলোও তো প্রমাণ সাইজ।

এসব গাছের মগডালেই তো ঘোরে লজ্জাবতী বানর, চশমাপরা হনুমান। তাদের দেখা না মিললেও গভীর বন থেকে উল্লুকের ডাক ভেসে আসছে কানে।

মোটামুটি প্রশস্ত একটা ছড়া পেরুতেই হাতের বাঁয়ে পড়লো বুনোর আদার ক্ষেত। তারপর কাঠে বাঁধানো মাটির সিঁড়ি মাড়িয়ে সোজা খাসিয়া পুঞ্জিতে।

গাছ থেকে পেড়ে আনা পান সাজাচ্ছে খাসিয়া মেয়েরা। এক ধরনের বেতলতায় বাঁধছে ১৪৪টি করে পান। একেকটির নাম কান্তা। এমন ২০ কান্তা মিলিয়ে যে ২০ কুড়ি হয় তা ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা করে বিক্রি করে খাসিয়ারা। সমতলের মতো এখানে মাচা নয়, গাছ পেঁচিয়ে আকাশ পানে ওঠে পান লতা।

এই পানের মধ্যে আবার নারী-পুরুষ ভাগ করা আছে চরিত্র বুঝে। মূল পানলতায় যে পান ফোটে সেটাকে এরা বলে বেটা পান, আর শাখা লতায় ফোটা পান হলো বেটি। বেটি পানের ঝাঁজ কম, বেটা পানের বেশি। সমতলের পানের সঙ্গে যেমন স্বাদের অনেক পার্থক্য খাসিয়ে পানের, তেমনি এর ঝাঁঝও বেশি। চাষ পদ্ধতিও আলাদা।

সমতলের পান হয় বরজে, আর খাসিয়া পান লতার মতো পেঁচিয়ে তোলা হয় গাছে। পুরুষদের পেড়ে আনা পান অদ্ভূত দক্ষতায় সাজিয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছে খাসিয়া মেয়েরা।

নিজেদের প্রকৃতি পূজার ধর্ম ছেড়ে অনেকেই এখন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখন আর মাতৃতান্ত্রিক সমাজের রীতি-নীতিও মানতে চাইছে না। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করা প্লাহাকেও দেখা গেলো, বিয়ের পর কনের বাড়ি না গিয়ে নিজের বাড়িতেই তুলে এনেছেন বউকে।

সব মিলিয়ে ৩৫ ঘর খাসিয়ার বাস এখানে। উঁচু টিলার ওপরে দরোজা-জানালাহীন খাসিয়াপুঞ্জি স্কুলটা খাঁ খাঁ করছে। তবে এই পুঞ্জির খাসিয়াদের অনেক ঘরেই সোলার এনার্জি, ডিশের লাইন। পাকা দালানও তুলেছেন কেউ কেউ।  

খাসিয়া পুঞ্জি থেকে নেমে ফিরতে পথে বাঁয়ের বনে একটু এগুতেই পাওয়া গেলো লেবুর বাগান। কিছুটা সমতল, কিছুটা টিলার গায়ে ঝুলে থাকা বাগানে চাষ হচ্ছে বীজহীন লেবু। চা বাগানের পর এই বীজহীন লেবুত গাছেই ছেয়ে গেছে লাউয়াছড়ার টিলাগুলো। বড় বড় বাগানগুলোতে পথ হারানোর শঙ্কা আছে।

শ্রীমঙ্গলের প্রায় ১২শ’ একর জমিতে এই বীজহীন লেবু চাষ হচ্ছে এখন। স্থানীয়রা একে বলে কাগজী লেবু। এই লেবু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে বেশি লেবু এখন শ্রীমঙ্গলেই ফলে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৬
জেডএম/

** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ