ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ধুলো ঝেড়ে কুশিয়ারার ইস্ট-ইন্ডিয়া ঘাট

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬
ধুলো ঝেড়ে কুশিয়ারার ইস্ট-ইন্ডিয়া ঘাট ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিলেট থেকে: তখন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব, অর্থাৎ ব্রিটিশ আমল। কলকাতা থেকে করিমগঞ্জ (আসাম) ছোট জাহাজ ও স্টিমার যাওয়া-আসা করে।

সঙ্গে কয়লা, লোহাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পথও কম নয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নৌ-যানগুলোর যন্ত্র বিকল হয়ে পড়তো।

এ অবস্থায় নদীপথের কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাহাজ-স্টিমার ঘাট বানানোর সিদ্ধান্ত নিলো কোম্পানি। সেখানে বিকল যন্ত্র সারানোর সব ব্যবস্থা থাকবে। মেরামতের সময়ে মালামাল নামিয়ে রাখার জন্য থাকবে গোডাউন, স্টাফ ও নাবিক-কর্মচারীদের থাকার সুব্যবস্থাসহ সবকিছু।

এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি কোথায়? কুশিয়ারা নদী।

কুশিয়ারার গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে- এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটির উৎস হচ্ছে বরাক বা বরবক্র নদী। বরাক নদীর উৎপত্তিস্থল মণিপুরের উত্তরে আঙ্গামীনাগা পাহাড়। এ নদী মণিপুর হয়ে কাছাড় জেলা ভেদ করে বদপুর দিয়ে সিলেটে প্রবেশ করেছে। সিলেট সীমান্তের অমলসিদ থেকে দুই শাখায় দু’টি ভিন্ন নামে প্রবাহিত হচ্ছে। এর একটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নদী সুরমা ও অন্যটি কুশিয়ারা। কুশিয়ারা নদীর দৈর্ঘ্য ১২০ মাইল।

সরেজমিনে জানা গেছে, বর্তমানে এ নদীর যেখানে ফেঞ্চুগঞ্জ ব্রিজ পড়েছে, সেখান থেকে ঢাকা-সিলেট রেলওয়ে ব্রিজের একটু আগ পর্যন্ত ফেঞ্চুগঞ্জের দিকের পাড়ঘেঁষে ছিলো এই ঘাটের কর্মযজ্ঞ। প্রায় চার-পাঁচ একরের এ ঘাটের উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণে গাড়লি বিল, পূবে ঢাকা-সিলেট রেলওয়ে ব্রিজ ও পশ্চিমে গাড়লি কালভার্ট।

এখন এ অঞ্চলটির দাফতরিক নাম ইসলাম বাজার।

ফেঞ্চুগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মী আবুল হোসেনের (৬৩) বাবা রুহুল আমিন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে স্টিমার চালাতেন।

বাবার কাছে শোনা গল্প থেকেই আবুল বললেন, ‘ইসলাম বাজার হওয়ার আগে এ অঞ্চলটির নাম ছিলো বংশাল। আমরা এই ঘাটকে স্টিমার ওয়ার্কশপ বলেই জানি। এখানে স্টিমার মেরামত হতো’।  

হেঁটে হেঁটে সে সময়কার ভবন, প্রাচীর, গেট, গাছ বা বিশেষ জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখালেন আবুল হোসেন। সেইসঙ্গে বলতে থাকলেন যা জানেন, ‘ঘাটে সব সময় ৩০ থেকে ৫০টি স্টিমার থাকতো। কয়লা রাখার গুদাম, পানি গরম করার গিজার, পাইলট বাংলো সবই ছিলো। এখন তো সব উপজেলা পরিষদের সম্পত্তি। স্বাধীনতার (১৯৭১) আগে কোম্পানি এটি নিলাম করে দেয়’।

ঠিক কতো সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বিষয়ে কোনো তথ্য মিললো না। তবে কোম্পানির শতাব্দী প্রাচীন সেই ঐতিহাসিক বাড়িগুলোর কিছু কিছু এখনও রয়ে গেছে। নানা কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হয়। কোনোটি স্কুল, কোনোটি মসজিদ- এমনকি বর্তমান উপজেলা পরিষদের ভবনটিও কোম্পানির করা। ছোট ছোট ঘরগুলো পরিষদের স্টাফরা নিজেদের খরচে মেরামত করে থাকেন। কিছু পুরনো ভবন ছাড়া কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই, এখানে এক সময় মহাযজ্ঞ চলতো!

বহু পুরনো ফাইলের ধুলো ঝেড়ে পড়ার মতো ঐতিহাসিক এ ঘাট দেখতে যেতে পারেন ইতিহাসপ্রেমিরা। সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে সরাসরি বাস বা ট্রেনযোগে ফেঞ্চুগঞ্জ সদর। সেখান থেকে রিকশায় দশ মিনিটের রাস্তা। বললেই হবে, উপজেলা পরিষদ। গাড়লি কালভার্ট হলেই ধরে নেবেন, ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছেন!

প্রাক্তন ঘাটের নদীর পাড়টি এখন বেদেদের দখলে। কোল ঘেঁষে চলে গেছে পাকা রাস্তা। তার ওপারে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কার্যালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, সাব-রেজিস্ট্রার ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়। এর আশপাশে ছড়ানো সেই আমলের কিছু বাড়ি।

এক সময় ঘাটভর্তি স্টিমার ও মানুষের কর্মব্যস্ততার ঢেউ উঠতো কুশিয়ারার জলে-স্থলে। সেসব স্রোতে ভেসে গেছে কবে! পাড় থেকে ঘোলা জলের উচ্চারণে কান পাতলে বুঝি শোনা যায়-
‘সময় সবুজ ডাইনি,
পৃথিবীর উপকণ্ঠে থাকো,
নাবিকের হাড় দিয়ে,
সন্ধ্যার উঠোনে তুমি,
ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকো। ’


বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬
এসএনএস/এএসআর

আরও পড়ুন...

*** অরূপরতনের সন্ধানে শ্রীচৈতন্যের বাস্তুলীলায়
*** জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে রেমা-কালেঙ্গা
*** রহস্যই থেকে গেলো যজ্ঞকুণ্ডের ধারা  
*** পিছুটান মুছে দেবে ভাড়াউড়া হ্রদ
*** লাউয়াছড়া গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া আসে
*** ‘সবাই বন্যপ্রাণী এনজয় করে কিন্তু তাদের কথা ভাবতে চায় না’
*** ওদের ট্রেন, মোদের ট্রেন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ