ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

পাখিরা আগে, পরে বাড়ির লোকেরা

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৬
পাখিরা আগে, পরে বাড়ির লোকেরা ছবি: আবু বকর সিদ্দিকী-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সালিয়া (সিলেট) থেকে: গাছে পাতা নাকি বকের সংখ্যা বেশি- এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ, সাদা বকে ঢেকে গেছে সবুজ পাতা।

ঠিক যেন সাদার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সবুজ।

পাশের গাছে কয়েক হাজার পানকৌড়ি। এ গাছটিতেও শত শত পাখির বাসা একটির সঙ্গে আরেকটি ঠাসা, বাসা করার উপযোগী কোনো ডালই আর বাকি নেই। প্রত্যেক বাসা থেকেই পানকৌড়ির চি-চি আওয়াজ।

পাশের বাঁশঝাড়েরও একই অবস্থা। কয়েক শতাধিক সাদা বক আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছ। ঠিক যেমন করে নিজের বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকে মানুষ।
 
সিলেট বিমানবন্দর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের সালিয়া গ্রামের ‘সালিয়া বড়বাড়ি’র ব্যতিক্রম চিত্র এটি।

বাড়িটির প্রায় দুই বিঘা আয়তনের পুকুরের চারদিকে নানা জাতের এসব গাছের সবগুলোই পাখিতে ভরপুর। দূরে হাওর থেকে আরও ঝাকে ঝাকে বক, পানকৌড়ি এসে বসছে রেইনট্রির পাতার ওপরে। আগের পাখিগুলোও একটু আধটু সরে গিয়ে অন্যকে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করলেও পাখিদের মধ্যে কোনো ভয়-ভাবান্তর নেই। মানুষের সাড়া পেলে পাখিরা যে তীক্ষ্ণ নজর রাখে, এখানে তাও নেই। দেখা গেলো না।
 
আরও অবাক বিষয় হলো, বাড়িটির উত্তর ও দক্ষিণে একই ধরনের গাছপালা, বাঁশঝাড় ও পুকুর থাকলেও সেখানে পাখির টিকিটি পর্যন্ত নেই।
 
কেন এই একটি নির্দিষ্ট পুকুর ও বাড়িকে ঘিরে এতো বক ও পানকৌড়ি? আর পাকা সড়কের এতো কাছের দৃষ্টিসীমায় পাখিগুলোর নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকার ভরসারই বা কারণ কি?

এ কৌতূহলের জবাবে বাড়িটির গৃহকর্তা এমদাদুল হক জানালেন, ‘এখানে পাখির অগ্রাধিকার, তারপর বাড়ির লোকেদের’।

বিছানাকান্দি সড়ক ধরে দক্ষিণের দিকে ৫০ গজ এগিয়ে পুকুরের দক্ষিণ পাশে বাড়িটির বিশাল ফটক। ফটকের ওপাশে পাকা করা বিশাল উঠানের পরে একটি সুরম্য দোতলা ভবন। প্রায় আড়াই একর জমিজুড়ে বাড়িটির চারদিকে সীমানা প্রাচীর।
 
মুল ফটকের ভেতরে বামে দুই বিঘার পুকুরটি। ডানে প্রায় ২০ শতাংশ জায়গা জুড়ে লোহার নেট দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে আপন মনে বিচরণ করছে তিনটি হরিণ। হরিণের সেডের সামনে একটি সেডে রয়েছে দু’টি বানর। প্রাণীগুলোর চেহারা বেশ নাদুস-নুদুস।
 
সামীনা প্রাচীরের সঙ্গেও রয়েছে বাহারি ফুল, ফল, কাঠ ও ওষুধি গাছ। সেগুলোতেও বাসা বেঁধেছে, বক, পানকৌড়ি, ঘুঘু, তিন জাতের শালিক, বাবুইসহ নানা জাতের পাখি। অনেক পাখিই গাছের নিচের ডালে হাতের নাগালে বসেই আয়েশ করছে। আর কলতানে মুখরিত করে রেখেছে পুরো বাড়ি।
 
স্থানীয়দের কাছে হক সাহেব নামে পরিচিত গৃহকর্তা এমদাদুল হক বললেন, ‘আমার বাবা হাজী মরহুম নুরুদ্দিন পাখি ভালোবাসতেন। ২০০৪ সালে বাজারে গিয়ে দেখেন, এক লোক কিছু ঘুঘু ও বক বিক্রি করছিলেন। বাবা সবগুলো কিনে এনে বাড়ির গাছে ছেড়ে দেন। ঘুঘুগুলো একদিন থেকে চলে যায়’।
 
‘পাখিগুলো থাকল না গেলো সেদিকে বাবার কোনো লক্ষ্য ছিল না। বাজারে কোনো পাখি দেখলেই কিনে এনে বাড়ির গাছে ছেড়ে দিতেন। তাদের খাবারের জন্য বাজার থেকে মাছ এনে পুকুরে ছাড়তেন। কিছুদিন পর দেখলাম, আস্তে আস্তে পাখির সংখ্যা বাড়ছে’।

পাখির সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংখ্যা বলতে পারবো না। তবে রাতে টর্চ জ্বালালে মনে হয় যেন, সাদা ফুল ফুটে আছে’।
 
‘আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপেসহ বেশ কিছু ফলের গাছ রয়েছে বাড়ির মধ্যে। এগুলো থেকে ফল খেতে বারণ করতেন বাবা। বাড়ির ফল রেখে বাজার থেকে কিনে এনে খেতেন। সেই থেকে সব ফল পাখিরাই খায়’- বলেন এমদাদুল হক।

‘বাড়ির ভেতরের পুকুরটিও বক ও পানকৌড়ির জন্য উন্মুক্ত। সেখান থেকেও খুব একটা মাছ ধরা হয় না’।
 
তিনি জানালেন, ‘সারা বছর পাখিগুলো এখানে থাকে না। বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রজননকালে তারা এখানে আসে। ১২ বছর ধরে কোনো বছরেই ব্যতিক্রম হয়নি। পাখিগুলো নিশ্চিন্তে বংশবিস্তার করে আবার হাওরে চলে যায়’।
 
‘প্রজননকালে তাদের নিরাপত্তা, বাচ্চাদের নিরাপত্তা ও বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে বাড়িতে দু’জন লোক আছেন। তারা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। কোনো বাসা থেকে বাচ্চা পড়ে গেলে আবার মায়ের কোলে তুলে দেওয়া, কেউ যাতে বিরক্ত না করে বা ধরে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সদা তৎপর তারা’।
 
এমদাদুল হক বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করি। আর কেউ যেন পাখি শিকার করতে না পারেন, সেজন্য সিলেট সদর থানা পুলিশ সহায়তা করে আসছে’।
 
গৃহকর্তা বলেন, বাবা বাড়িটির নাম রেখেছিলেন ‘সালিয়া বড়বাড়ি’। মূল ফটকের শ্বেতপাথরে খোদাই করে লিখেছিলেন। কিন্তু পাখির কারণে সেই নাম চাপা পড়ে গেছে। স্থানীয়দের কাছে এ বাড়ি এখন ‘পাখিবাড়ি’ নামেই সমাদৃত’।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৬
এসআই/এএসআর

*** চায়ের দেশে চা জাদুঘর​
*** গরুও মানিয়ে নিয়েছে হাওরকে
*** ‘শ্রীমঙ্গল কিন্তু এক্কেবারে অন্য ধাঁচের’
*** মুভি দেখে পুলিশে যোগদান
*** ভোরের স্নিগ্ধ লাউয়াছড়া-১
*** লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা
*** হ-য-ব-র-ল বগিতে ভোগান্তির পারাবত!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ