ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

‘বাংলার আমাজন’ রাতারগুল

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৩ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
‘বাংলার আমাজন’ রাতারগুল ছবি: দেলোয়ার হোসেন বাদল-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাতারগুল (সিলেট) ঘুরে: চারদিকে অথৈ পানি। নেই  কোনো কোলাহল, আছে শুধু পশু-পাখির ডাক।

মাঝে মাঝে মৃদু বাতাসে জলাভূমির ছোট ঢেউ বাড়ি খাচ্ছে গাছের সঙ্গে। হিরণ্ময় নীরবতার মাঝে সেসব শব্দে মুগ্ধ করছে রাতারগুল বন।

জলাভূমির মধ্যে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি হিজল, জাম, বরুন, করচ (স্থানীয় নাম) গাছের বিশাল এক জঙ্গল। এতোই ঘন জঙ্গল যে ভেতরের দিকটায় সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে জল ছুঁতে পারে না।
 
রাতারগুলের বনে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায় নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী আর পাখি। রাতারগুল ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষকাল। ভরা বর্ষায় এই জলাভূমির যৌবনে পূর্ণতা পায়। ছোট ডিঙি নৌকায় বৈঠা বেয়ে বনের ভেতর যেতেই কানে আসছে পাখির কল-কাকলি, জলের কলকল শব্দ।

১৯৭৩ সালে এ বনের ৫শ’ ৪ একর এলাকাকে বন্যপ্রাণির অভয়াশ্রম ঘোষণা করে বন বিভাগ। বনের বর্তমান আয়তন অবশ্য ৩শ’ ৭৫ একর।

অনেকেই এটাকে  ‘বাংলার আমাজন’ বলে থাকেন।
 
সিলেট শহর থেকে রাতারগুলের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ বনের অবস্থান। ভেতরে পাঁচটি ‘কুড়ি’ (স্থানীয় নাম) পুকুর রয়েছে। বর্ষার পরে পানি শুকিয়ে গেলে এসব পুকুরে হরেক রকম মাছ পাওয়া যায়। বনের ভেতরের টাওয়ারের চূড়ায় উঠলে পুরো রাতারগুল বনকে মনে হবে যেন পানিতে ভাসা কোনো বন।
 
রাতারগুল একটি প্রাকৃতিক বন। এরপরও হিজল, বরুণ, করচ আর মুতাসহ কিছু জলবান্ধব জাতের গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। রাতারগুলে রয়েছে কদম, জালিবেত, অর্জুনসহ জলসহিষ্ণু আরও প্রায় ২৫ প্রজাতির গাছপালা।
 
সিলেটের শীতলপাটি তৈরির মূল উপাদান মুতার বড় অংশ এ বন থেকেই আসে।
 
এখানে আছে মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, ফিঙে, বালিহাঁস, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখি। বন্যপ্রাণীর মধ্যে আছে বানর, উদবিড়াল, কাঠবেড়ালি, মেছোবাঘ ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতির গুঁইসাপ ও নানা ধরনের সাপের অভায়শ্রমও এই বন।
 
জঙ্গলের একেবারে শুরুর দিকটায় মুতার বন। এর বেশির ভাগই জলে ডুবে থাকে বর্ষায়। এর পরেই শুরু আসল বন। যতোই গহীনে যাওয়া যাবে ততোই গাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। অনেক জায়গায়ই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। দুই-একদিন বৃষ্টি না হলে পানি এতো বেশি স্বচ্ছ হয় যে, বনের সবুজ প্রতিবিম্বকে মনে হয় বনের নিচে আরেকটি বন।
 
রাতারগুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে অবশ্যই নি:শব্দে যেতে হবে। কোনো রকম হই, হুল্লা, চিৎকার, চেচামেচি করলে এর প্রকৃত সৌন্দর্য কোন ভাবেই উপভোগ্য হবে না। নি:শব্দে ঘুরলে পানির ভেতর অবস্থিত এই বনের ঘুঘুর ডাক, বানরের লাফালাফি দেখা যায়। এটাই রাতারগুলের সৌন্দর্য।
 
রাতারগুলসহ অন্যান্য বন সংরক্ষণে বেসরকারি সংস্থা ইউএসএইড ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেমস অ্যান্ড লাইভলিহুডস’ (ক্রেল) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বন সংরক্ষণে মানুষকে সচেতন করতে বন সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এ প্রকল্পের কাজ করছে সংস্থাটি।
 
ক্রেলের আঞ্চলিক কর্মকর্তা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বনকে রক্ষা করতে হলে বন  নির্ভরশীল লোকের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আমরা বনের ওপর নির্ভরশীল বা বনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি সহ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে কাজ করছি। ফলে বনের গাছ কাটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে’।     

তবে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের কিছু  অংশ এখনো একটি সিন্ডিকেট চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে বলে স্থানীয়দের দাবি। রাতারগুল গ্রামের বাসিন্দারাই এ বনের জন্য হুমকিস্বরুপ বলেও মনে করেন তারা।
 
রাতারগুলের আশেপাশে ৯টি গ্রাম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- মহিষখেড়, জলুরমুখ, মটারগেট, বাগবাড়ি, রামনগর, দেওয়ানগাঁও, রাতারগুল, চালিতাবাড়ি ও বাইমারপাড়।
 
এর মধ্যে রাতারগুল বনে যাওয়ার জন্য মহিষখেড়, মটারগেট ও রাতারগুল গ্রামের পথ ব্যবহার করা হয়। এ বনে প্রবেশ করতে এখনো কোনো টিকিট বা  টোকেনের ব্যবহার শুরু হয়নি।

আরও পড়ুন...

**মেঘ-পাহাড়-ঝরনা-নদীর মুগ্ধতা পানতুমাইয়ে​
 *** বিছানাকা‌ন্দির জলের ওপর ‘জলপরী’
** ডু‌বে ডুবে ঘাসও খায় তারা
**ছয় মাস কৃষক, ছয় মাস বেকার
** বর্ষায় মাঝি, শুকনায় রাজমিস্ত্রি
** পানি নয়, সাতছড়ির ছড়ায় এখন শুধুই বালু
**প্রকৃতিপ্রেমিদের জন্য অনন্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
** ভাড়াউড়া লেকের সৌন্দর্যে কালো মেঘ যোগাযোগ ব্যবস্থা
**লাউয়াছড়ায় ১৫ হেক্টরের মধ্যেই দর্শনার্থী সীমাবদ্ধ
**লাউয়াছড়ায় অর্থকরী ফসলের আত্মকথা
**নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন মিহির কুমার দো

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
এসএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ