ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

লাউয়াছড়ার কোর জোনে বিদ্যুৎ সংযোগ!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০১৬
লাউয়াছড়ার কোর জোনে বিদ্যুৎ সংযোগ! ছবি: সেরাজুল ইসলাম সিরাজ

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে ফিরে: উদ্যানের ঠিক মাঝ দিয়ে চলে গেছে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ পাকা রোড। রাস্তার উভয় পাশে বিদ্যুৎ লাইন।

  তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রায়ই মারা পড়ছে মুখপোড়া হনুমান।
 
উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা বিদ্যুতের লাইন সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এমন পরিস্থিতিতে গহীন বনের লাউয়াছড়া পুঞ্জিতে (খাসিয়া পল্লী) নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।
 
পুঞ্জিতে বিদ্যুৎ সংযোগের বৈধতা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। বন বিভাগ বলছে, লাউয়াছড়া পুঞ্জি জাতীয় উদ্যানের কোর এলাকায়। এখানে কোন রকম স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ নেই। আর স্থাপনাই যখন অবৈধ সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়াও নিশ্চয়ই অবৈধ।
 
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে ওই অঞ্চলকে কোর জোন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। “কোর জোন”- অর্থ “সংরক্ষিত এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যমান বন এলাকা, যাহা জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এবং যেখানে বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ বংশবৃদ্ধির জন্য সকল ধরনের বনজদ্রব্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও পর্যটক প্রবেশ সীমিত করার জন্য ব্যবস্থাপনা করা হয়”।
 
ওই আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, “সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বংশ বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের জন্য জনসাধারণের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ বা বনজদ্রব্য আহরণ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রক্ষিত এলাকার কেন্দ্রস্থলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বন বা দীর্ঘমেয়াদী বনকে, কোর জোন হিসাবে ঘোষণা করিতে পারিবে”।
 
যথারীতি লাউয়াছড়ার এই পুঞ্জি এলাকাকে কোর জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন সেখানে তাদের থাকাটাই অবৈধ। আইনে সেখানে পর্যটক প্রবেশেও নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। সেই কোর জোনের স্থাপনায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে বৈধতা দেওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম।
 
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা ওই লাইনগুলো মাটির নীচ দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আসছি। কিন্তু বিদ্যুতের লোকজন কানে নিচ্ছে না।
 
কোর জোনে যেখানে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে- বেশ কিছু সেমিপাকা ঘর। পুঞ্জির হেডম্যানের (মন্ত্রী) দ্বিতল বাসভবন।
 
অভিযোগ আছে, বন বিভাগের আপত্তি উপেক্ষা করে ক্ষেত্র বিশেষে তাদের যোগসাজশেই স্থাপিত হচ্ছে পাকা বসতি।
 
তবে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার শিবু লাল বসু বাংলানিউজকে বলেন, লাউয়াছড়া পুঞ্জিতে প্রথমে খোলা তারে বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেও বন বিভাগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কভার লাগানো তার দেওয়া হয়েছে। এতে বন্যপ্রাণীর কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
 
বিদ্যুৎ সংযোগের বৈধতা প্রসঙ্গে পল্লী বিদ্যুতের এই কর্মকর্তা জানান, খাসিয়ারা একশ’ বছর ধরে সেখানে থাকে। বারো বছর থাকলেই তো ভোগ দখল সূত্রে মালিক হয়ে যায়।
 
‍চাপাইনবাবগঞ্জে আম বাগানের ভেতর দিয়ে প্লাস্টিকের কভারে মোড়ানো তার টাঙানোর নজির রয়েছে। এখানেও সেটা করার সুযোগ ছিল। তাহলে বেঘোরে প্রাণ যেতো না বণ্য প্রাণীগুলোর। খোলা তারে জড়িয়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাণী মারা পড়ছে, অন্যদিকে বৈদ্যুতিক লাইনে গাছের ডাল লেগে সিস্টেমলস বাড়ছে। সে কারণে কিছুদিন পর পর আশপাশের ডালগুলো কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন।
 
মৌলভীবাজার বণ্যপ্রাণী রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, গত বছরের ১১ মার্চ একটি মুখপোড়া হনুমান বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। কোমর ভেঙে যাওয়া হনুমানটিকে রেসকিউ সেন্টারে কয়েকদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। তারপরও ২১ মার্চ মারা যায় মুখপোড়া হনুমানটি।
 
এর আগেও খোলা তারে জড়িয়ে বেশ কিছু প্রাণী মারা গেছে। লাউয়াছড়ায় বিশ্বের অনেক বিপন্ন প্রাণীর বিচরণ। যে কারণে জাতীয় উদ্যান ঘিরে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও গবেষকদের আগ্রহ বেড়েই চলছে। গত অর্থবছরে ২৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে টিকিট থেকে। ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে বিশ্বের আর কোথাও এতো পর্যটকের আগমন রেকর্ড করা হয়নি বলে জানিয়েছেন তবিবুর রহমান।
 
লাউয়াছড়া যখন আগ্রহের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, ঠিক সেই সময়ে চারদিক থেকে গলা চেপে ধরা হয়েছে উদ্যানটিকে। একদিকে পাকা রাস্তায় প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে বিভিন্ন প্রাণী। দাবি রয়েছে পাকা রাস্তা বাইপাস করে দেওয়ার। কিন্তু আমলে নেওয়া হয়নি। বিকল্প প্রস্তাব উঠেছিল রাতের বেলা যান চলাচল বন্ধ রাখার, তাও করা যায়নি। এমনকি গতিরোধক বসানোর প্রস্তাবেও সায় মেলেনি সড়ক বিভাগের।
 
জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়েছে সর্বোচ্চ গতিবেগ ২০ কিলোমিটার লিখে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাইরে ধীরে চললেও বনের ভেতরে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গতি ‍বাড়িয়ে দিচ্ছে চালক। ফলাফলও যা হবার তাই হচ্ছে।
 
ঠিক মাঝ দিয়ে গেছে রেল লাইনও। সেখানেও কাটা পড়ছে বানর, হনুমানসহ বিভিন্ন প্রাণী। এ ক্ষেত্রে রেললাইন বাইপাস করার প্রস্তাব উঠেছে। কিন্তু রেলওয়ে বিভাগ অনড়, তারা দু’পাশে আরও ৫০ হাজার গাছ কেটে নিষ্কন্টক করতে চায় রেলের পথচলাকে। গাছ কাটতে বাধা দিলে জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকিও দিয়ে রাখা আছে।
 
রয়েছে খাসিয়াদের উৎপাত। তারা পান চাষের জন্য গাছের ডালপালা ও ডগা ছেটে দিচ্ছে। এক সময় আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে শতবর্ষী অনেক গাছ। আবার নিচের ঝোপঝাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে লেবু বাগানের ক্ষেত্র। সব মিলিয়ে দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে লাউয়াছড়ার দৃশ্যপট।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০১৬
এসআই/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ