ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৬
পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর ছবি: সোহেল সরওয়ার-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দেবতা পুকুর (মহালছড়ি)ঘুরে: নূনছড়ি নদী পার হতেই শুরু হলো সিঁড়ি বাওয়া। দু’পাশে ঘনবন।

মাঝে পাহাড়ের ঢালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রসস্ত সিঁড়ি। কয়েক তলা সমান সিঁড়ি বাওয়ার পর প্রসস্ত ল্যান্ডিংয়ে জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ। কিছু দূর পরপর যাত্রী ছাউনির আদলে বিশ্রামাগার।

খানিকটা ওঠার পর ঢাল বেয়ে কিছুটা নামা। তারপর ফের সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের শরীর বাওয়া। একটা সময় তো মনে হলো, এ সিঁড়ির বুঝি শেষ হবে না আর।

শত শত সিঁড়ি বাওয়ার পর একটা আদিবাসি দোকান পেয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ বশে রাখা গেলো না।

দু’দণ্ড জিরানোর ফাঁকে পেটে ঢুকলো ১ টাকা দরের গোটা চার অতি সুস্বাদু পাহাড়ি কলা। চার কেজি ওজনের একটা গাছ পাকা পেঁপে পাওয়া গেলো মাত্র ৬০ টাকায়।

পেঁপে আর কলায় উদোর পূর্তি করে শক্তি বাড়লো শরীরের। কাঠের বেঞ্চি থেকে শরীর তুলে একটু সামনে বাড়তেই বিশাল পুকুরটা নজরে এলো। আর একটু এগুতেই দেখা গেলো, ডজন দেড়েক পাহাড়ি কিশোর পানিতে দাপাচ্ছে। পাকা ঘাটে প্রদীপ জ্বালিয়ে জল দেবতার পূজোয় ব্যস্ত আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা। পিকনিক পার্টির একটা মাইক দেবতা পুকুরের নির্জনতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিতে চাইছে যেনো।

৫ একরের লম্বাটে পুকুরের চারিপাশে ঘন সবুজ গাছের দেওয়াল। ওই গাছ সারির কারণেই বুঝে ওঠা দায় যে, এই পুকুর ভূমি থেকে প্রায় সাতশ’ ফুট উপরে।
এতো উপরে হলেও কখনোই শুকায় না এ পুকুরের পানি। ত্রিপুরা উপজাতির লোকেরা এ পুকুরকে তীর্থ মনে করে। তাদের ভাষায় এ জলাশয়ের নাম মাতাই পুখির। মাতাই অর্থ দেবতা, আর পুখির অর্থ পুকির। এ পুকরকে দেবতার পুকুরই মনে করে তারা।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, খোদ জলদেবতা স্থানীয়দের জলতৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই পুকুর খনন করেন। তাই এ পুকুরের পানিকে দেবতার আশীর্বাদ মনে করে তারা। তারা আরো মনে করে, এ পুকুরের নিচে অনেক গুপ্তধন লুকোনো আছে, যেগুলোর পাহারায়ও আছেন দেবতারাই।

প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে তীর্থ মেলা বসে এখানে। এখানে তখন পুণ্যার্থীদের ঢল নামে। ভক্তি ভরে পুকুরের পানি পান করে পুণ্যার্থীরা। এখানে এসে কিছু চাইলে প্রত্যাশা পূরণ হয় বলেও বিশ্বাস প্রচলিত আছে।

আরো কথিত আছে, কোনো এক সময় এ পাহাড়ের পাশে ছিলো গোটা দুই জনবসতি। সেই জনবসতির এক জুমিয়া এ পাহাড়ের জুম চাষ করতো। একদিন তাকে স্বপ্নে এখানে জুম চাষ করতে বারণ করা হয়। কিন্তু জুমিয়া তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এরপর ফের ফের স্বপ্নে তাকে নরবলি দিয়ে জুমের ফসল ভোগ করতে বলা হয়।

কিন্তু ওই জুমিয়া এতে কান না দিলে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় কোনো এক অমাবস্যার রাতে। তারপর লোকজন দেখতে পায়, জুম ক্ষেতের স্থানে বিশাল এক জলাশয়।

আদতে এটি মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বলেও মনে করা হয়ে থাকে।

এ পুকুরের দৈর্ঘ্ প্রায় দেড় হাজার ফুট, আর প্রস্থ ৬শ’ ফুট। এ পাহাড়ের মাথা থেকে বেশ দেখা যায়, খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটির দিকে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী নদীর চিকচিকে জল, তার পেছনের পাহাড় শ্রেণি।
এই দেবতা পুকুরের অবস্থান খাগড়াছড়ি সদরের নূনছড়ি মৌজার আলুটিলা পাহাড় শ্রেণিতে। ওই পাহাড় থেকেই উৎপন্ন হয়ে এ পুকুর পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নূনছড়ি নদী।     

জেলা সদর থেকে এখানকার দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। এ পুকুর যে থানার ভৌগলিক সীমানায় তার নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা জনশ্রুতি।

এক মতবাদে বলা হচ্ছে, ত্রিপুরা রাজাদের রাজত্বকালে এ অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের জন্য একটি অফিস স্থাপন করা হয়। ত্রিপুরা ভাষায় এমনতরো অফিসকে বলা হয় মহাল। এ থেকেই মহালছড়ি নামের জন্ম।

তবে অপর এক ধারণায় বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলের ঝরণাগুলোতে এক সময় প্রচুর মাল বা মৃগেল মাছ পাওয়া যেতো। মাল মাছের এমন প্রাচুর‌্য থেকেই মহালছড়ি নামের উৎপত্তি।

** পাহাড়ের খাদে রাম-সীতার ধুমনিঘাটে
**বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
**বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে

** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা

বাংলাদেশ সময়: ০৬২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ