ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বিশ্বাসের বটে বনবিবির বাস

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৭
বিশ্বাসের বটে বনবিবির বাস বনবিবির বট। ছবি: ডিএইচ বাদল

সুন্দরবন ঘুরে: অতিকায় ছাতার আকৃতি নিয়েছে বিশাল বপুর বটগাছটা। লম্বা ডাল থেকে নামা ঝুল মাটিতে গেঁথে জন্ম দিয়েছে নতুন গাছের। সাড়ে ৩ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মূল মহীরুহ ঘিরে তাই তৈরি হয়েছে জীবন্ত গাছের খুঁটি। সব মিলিয়ে ডাল-পাতায় ছাওয়া গোলঘরের রূপ নিয়েছে বটগাছটা।

ডালে ডালে যার আগাছা-পরগাছার বসবাস। একখানে তো রীতিমতো একটা খেজুর গাছই দঁড়িয়ে গেছে ঝুলের ওপর।

আর গুঁড়ির কোটর থেকে অনবরত নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে গোটা দুই তক্ষক।

এ জায়গাটার পরিচিতি বনবিবির বটতলা নামে। বনজীবীদের বিশ্বাস, বাদাবনের রক্ষক বনবিবির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে এই বিশাল বটটার। এটার পাতায় পাতায় মিশে আছেন বনবিবি। তিনি বনজীবীদের কাছে স্বহিমায় পূজিত লোকজ দেবী।

বনবিবির জহুরানামায় বলা হয়েছে, তিনি বেরাহিম নামে এক আরবদেশী’র কন্যা। বেরাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতীনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্তা হন। সেখানে তার গর্ভে বনবিবি ও শাহ জাঙ্গুলী জন্ম নেন। কালক্রমে তাদের শক্ত আসন তৈরি হয় সুন্দরবনের লোকজ বিশ্বাসে। এই বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে চলে আছে বাঘ রূপী আর এক মানুষ দেবতা দক্ষিণ রায় আর পরোপকারী গাজী পীরের নাম।

বলা হয়ে থাকে, দুই লোভী চাচা ধনে আর মনে তাদের ভাতিজা দু:খেকে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ের হাতে তুলে দেন। কিন্তু বনবিবির নির্দেশে তার ভাই শাহ জাঙ্গুলী শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফেরত পাঠিয়ে দেন। আর দক্ষিণ রায় ও গাজীকে ধরে নিয়ে যান বনবিবির কাছে। প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে, দক্ষিণ রায়ের সঙ্গ ছেড়ে বনবিবির পক্ষ নেন গাজী। বনবিবির বটে গজিয়ে ওঠা খেজুর গাছ।  ছবি: ডিএইচ বাদল

যশোরের ব্রাক্ষ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীন ভাটির দেশের রাজা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে বনবিবির যুদ্ধ হয়। পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন দক্ষিণ রায়।

পরবর্তীতে মানুষের লোকজ বিশ্বাসে তৈরি হয় বনবিবির শক্ত ভিত। বনজীবীদের কাছে তিনি অরণ্যের দেবী রূপে পূজিতা। লোক বিশ্বাসে তিনি কখনো মুরগির রূপ ধারণ করেন, কখনো হন বাঘ। সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ভক্তবৎসলা এই দেবীর কারো ওপরে কোনো আক্রোশ নেই। বনের সমস্ত সৃষ্টিতে তার মমতা মাখা। তিনি ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতিকে।

তিনি সুন্দরবনের জেলে, বাউয়ালি বা কাঠুরে আর মৌয়াল বা মধু সংগ্রহকারীদের রক্ষাকত্রী। তিনি হিন্দুর বনদুর্গা বা বনদেবীর মুসলমানি রূপ। বনজীবীদের ধারণা, বাঘ ও ভূত-প্রেতের মতো অপশক্তির ওপরে কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তাই গভীর মনে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বনবিবির উদ্দেশ্যে শিরনি দেন ক্ষীর বা অন্ন।

তাকে নিয়ে মঙ্গল কাব্যের ঢংয়ে রচিত হয়েছে বনবিবির জহুরানামা নামে বিখ্যাত পুঁথিকাব্য। আরবী জহুরা বা হিন্দি জহুর শব্দের অর্থ কৃতিত্ব বা অলৌকিক শক্তি। আর ফারসি নামাহ শব্দের অর্থ পুস্তক বা নথিপত্র। এই কাব্যে বনবিবির অলৌকিক কীর্তিকলাপের বিবরণ পাওয়া যায়। এভাবে ডাল কেটে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বনবিবির বটের বিস্তার।  ছবি: ডিএইচ বাদল

প্রথমাংশে বনবিবির জন্ম-বৃত্তান্ত, মক্কা থেকে ভাটির দেশে আগমন ও প্রভাব বিস্তারের কাহিনী বর্ণিত। দ্বিতীয় ভাগে ধনাই-দু:খের পালায় বনবিবির পূজা প্রবর্তনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তবে আল্লাহ-রাসুল, মক্কা, পীর-পিরানী ইত্যাদি শব্দ জুড়ে আখ্যানকাব্যটিকে দেওয়া হয়েছে ইসলামীকরণের ছোঁয়া।  

এখানে বনবিবির নামে পরিচিত বিশাল বটের আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। মানিক পীরের মাজার নামে একটা আধা পাকা স্থাপনা আছে বটগাছের নিচে। এই সাতসকালে কোথা থেকে এসে তপন কুমার নামে এক ভদ্রলোক জানালেন, এই বটগাছটার জায়গাটা তার। পেয়েছেন পৈত্রিক সুত্রে। এখনো মেলা বসে এখানে। পহেলা বৈশাখে জমে ওঠে বনবিবির বটতলা। তবে আগের মতো আর ঋষী-সন্নাসীদের ধ্যান করতে দেখা ‍যায় না। বরং বিনোদনপ্রেমী আর পিকনিক পার্টি নিয়মিত আসে এই বটগাছ দেখতে।

ছড়িয়ে থাকা ডালের আগা দেখিয়ে তিনি বলেন, বেশী যাতে বাড়তে না পারে সেজন্য ওই ডালগুলো কেটে দেওয়া। চারিদিকে তো অন্যের জমি। যতোই হোক বনবিবির বট, আমার জায়গার গাছ তো যার অন্যের জমিতে কেউ মানবে না।    বনবিবির বটতলায় মানিক পীরের প্রতীকী মাজার।  ছবি: ডিএইচ বাদল

সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ রোডের সখীপুর মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে সোজা দেবহাটা উপজেলা পরিষদ মোড়ে নেমে আসতে হয় বনবিবির বটতলায়। ইঞ্জন ভ্যানে ভাড়া পড়বে ৮ থেকে ১০ টাকা। মোটর সাইকেলে ২০ থেকে ২৫ টাকা।

বনবিবির পূজা দক্ষিণ বাংলার আবহমান সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুন্দরবন লাগোয়া অঞ্চলে যেসব স্থানে বনবিবির পূজা হয় সেগুলোর মধ্যে মংলা থানার বানিশান্তা সংলগ্ন ঢাংমারি গ্রাম অন্যতম। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে বনবিবির মোট মন্দির সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। পশুর নদীর পশ্চিম পাড়েই কেবল ৩ শতাধিক স্থানে প্রতি জানুয়ারিতে বনবিবির পূজা হয়।

সাতক্ষীরায় শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ লাগোয়া মালঞ্চ নদীর উভয় পাড়েই বনবিবির মন্দির দেখা যায়। সম্প্রতি সেখানকার পানখালী চুনা জেলেপাড়াতে নতুন এক পাতা ঘরে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব মন্দিরের কোথাও কোথাও কেবল বনবিবি থাকলেও, অনেক স্থানেই তার সঙ্গে শাহ জাঙ্গুলী, গাজী আউলিয়া, শিশু দু:খে, তার দুই চাচা ধনে ও মনে, বাঘ রূপী দক্ষিণ রায়, কালু, ভাঙ্গড় ও মানিক পীর প্রমুখের প্রতিমা পূজিত হতে দেখা যায়। তবে এই বটতলায় কেবল বনবিবিরই একচ্ছত্র আধিপত্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ