ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

এ বসন্তেও ফুল ফুটবে ৫৫০ বছরের মাধবীলতায়

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৭
এ বসন্তেও ফুল ফুটবে ৫৫০ বছরের মাধবীলতায় পাটবাড়ি আশ্রমে সিদ্ধ মাধবীলতা গাছ/ছবি: আসিফ আজিজ

যশোর: ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জেলা যশোর। এ জেলাকে আরও ঋদ্ধ করেছে বেনাপোল। আর বেনাপোলের ঐতিহ্যের অন্যতম তীর্থস্থান ‘নামাচার্য ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর পাটবাড়ি আশ্রম’। আরও ভেঙে বললে, এই পাটবাড়ি আশ্রমের প্রধান আকর্ষণ হরিদাস ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ‘সিদ্ধবৃক্ষ মাধবীলতা ও তমালবৃক্ষ’।

মাধবীলতা আর তমালে কিসের আকর্ষণ আর কেনই বা তা ‘সিদ্ধ’ সে গল্পে (আসলে গল্প নয়, সত্যি) যাওয়ার আগে ঠাকুর হরিদাস সম্পর্কে অন্তত কিছু কথা জেনে রাখা ভালো। এ কারণে যে, ইতিহাস বলি আর ঐতিহ্য- তা মানুষই সৃষ্টি করে।

না, ঠিক মানুষ না, তারা মহামানব। মানুষ হয়েও মানুষের অতীত। আমাদের যেখানে শেষ মহামানবের শুরু সেখান থেকেই।

হরিদাসের জন্ম ১৪৪৯ সালে। সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার অন্তর্গত কেড়াগাছি গ্রামে। অতঃপর শৈশব থেকে কৈশোর। কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে কী যেনো এক ভাবের উদয় হয়। সে ভাব তাকে গভীর থেকে আরও গভীরে নিয়ে যায়। অন্তরে তার অন্তর্যামী মহাপ্রভু খেলা করে আর ভাবজগতে ব্রহ্মলোক। জগতের যিনি মালিক- তিনি এক, মানুষ সেওতো এক। নানা রঙে, নানা ঢঙে তার প্রকাশমাত্র। কিন্তু ঈশ্বর নিত্য, ঈশ্বর সত্য, তিনি অব্যয়, তিনি অক্ষয়। সবার হৃদয়েই তিনি বাস করেন। তিনি পরমেশ্বর, মহাপ্রভু। কৈশোর থেকেই হরিদাসের হৃদয়ে সেই পরমেশ্বরের প্রকাশ ঘটে ‘হরে কৃষ্ণরূপে’। তাই অন্তরে তার সদা জাগ্রত‘হরে কৃষ্ণ’, মুখেও তার সদা উচ্চারিত‘হরে কৃষ্ণ’আর ভাবে তার সদা বিরাজমান ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে’।

পাটগ্রাম আশ্রমের সিদ্ধ মাধবীতলা গাছ/ছবি: আসিফ আজিজএ ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। কিন্তু এ হরিনামই হলো তার কাল। নির্যাতন, বেত্রাঘাত, চাবুকের আঘাত কোনো কিছুই বাদ গেলো না। তবুও জবান  থেকে তার হরিনাম দূর হলো না। অবশেষে ভিটেমাটি ছাড়তে হলো হরিদাসকে। হরিনামকে সঙ্গে করে ঠাকুর মনুষ্য লোকালয় ছেড়ে নির্জন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটলেন। ছুটতে ছুটতে তিনি এসে আশ্রয় নিলেন এক নির্জন জঙ্গলে। যেখানে ‘নামাচার্য ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর পাটবাড়ি আশ্রম’ আজ থেকে ৫৬১ বছর আগে সেখানে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কথিত আছে এখানে ছোট একটি আশ্রম আগেও ছিল। তবে তা এখনকার মতো নয়।  

পাটগ্রাম আশ্রমের সিদ্ধ মাধবীতলা গাছ/ছবি: আসিফ আজিজহরিনাম জপ করতে করতে এক সময় তিনি দিনে তিনলক্ষবার হরিনাম জপ করতে শুরু করলেন। এবং পণ করলেন প্রতিদিন তিনলক্ষবার হরিনাম কীর্তন না করে কোনো আহার গ্রহণ করবেন না।  

এখানে একটি পর্ণ কুটিরে বসেই তিনি তিনলক্ষবার হরিনাম জপ করতে শুরু করলেন। ধীর ধীরে এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভক্তদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সেই জঙ্গলাশ্রম পরিণত হলো এক মহাতীর্থস্থানে।  

এই মহাতীর্থস্থানের সবকিছুই এখন নতুন। নতুন ফটক, নতুন ভবন, নতুন প্রতিমা, নতুন জাদুঘর, নতুন ভক্ত। সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই পরিবর্তিত। পুরোনোর মধ্যে রয়ে গেছে শুধু দুটি গাছ- মাধবীলতা ও তমালবৃক্ষ। পুরনো সেই পর্ণ কুটির এখন ইট-পাথরের ভবন।    
এ গাছ মরে যাওয়ার কথা বহু আগেই। কিন্তু মরেনি। হয়তো লতায়, পাতায় আর ফুলে-ফুলে ঠাকুর হরিদাসের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে আজও। ভক্তরা একে বলে ‘সিদ্ধবৃক্ষ মাধবীলতা’।

পাটগ্রাম আশ্রমের সিদ্ধ তমাল গাছ/ছবি: আসিফ আজিজআশ্রমের প্রধান পুরোহিত মাধব দাশের কাছে জানতে চাইলাম কেন একে সিদ্ধবৃক্ষ বলছেন? তিনি শোনালেন সেই কথা- একটি মাধবীলতা গাছ বাঁচে বড়জোর ১০ থেকে ১৫ বছর। কিন্তু এর বয়স ৫৪৫ বছর। আজও দাঁড়িয়ে আছে এ গাছ। শুধু তাই না, প্রতিবসন্তেই ফুল দেয় এ মাধবী গাছটি। লালচে সাদা ফুলে ভরে ওঠে মাধবীতলা। আসছে বসন্তেও ফুল ফুটবে এ মাধবীলতায়। মধ্য বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম পর্যন্ত প্রায় দেড় মাস ফুল দেয় এই মাধবীলতা।

ঠাকুর হরিদাস বেনাপোলের এ পাটবাড়ি আশ্রমে এসেছিলেন ১৪৭১ সালে। তিনি আসার আগেও এ গাছটি ছিল। তখন এটি ছিল একটা ছোট্ট লতাপাতার মতো। ৫৪৫ বছরে এ গাছটি এখন শক্ত কাণ্ডের একটি গাছে পরিণত হয়েছে। মাধবীলতা ফুলের গাছ এতো শক্ত কাণ্ডের কখনো হয় না।

তিনি আরও জানালেন, এই মাধবীলতা গাছের নিচে বসে ঠাকুর হরিদাস প্রতিদিন তিনলক্ষ বার হরিনাম নাম জপ করতেন। এখানে বসেই তিনি হরিনাম চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। হিরা বাঈ হরিদাসের নাম ভজন লণ্ডভণ্ড করতে যখন এখানে এলেন, তখন হরিদাস এই মাধবীলতা গাছের নিচে বসেই হরিনাম জপ করছিলেন। কিন্তু, হিরা বাঈ হরিনাম নাম ভজন লণ্ডভণ্ড করতে গিয়ে নিজেই হরিদাসের কাছে দীক্ষা দিলেন।

পাটগ্রাম আশ্রমের সিদ্ধ তমাল গাছ/ছবি: আসিফ আজিজহরিদাস-জীবনের আরও নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এ সিদ্ধবৃক্ষ মাধবীলতা।

কথিত আছে, মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের হাতের লাঠি রেখে যান এই পাটবাড়ি আশ্রমে। সেই লাঠি (শষ্ঠি) থেকেই এ তমাল গাছটির জন্ম। অদ্বৈত মহাপ্রভুর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ভক্তদের কাছে এ তমাল গাছটিও পূজনীয়। আশ্রমের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে এ তমাল গাছটি।  

বেনাপোল বাজার থেকে অল্পদূরেই পাটবাড়ি। পথধরে এগোতেই চোখে পড়বে এ আশ্রম। আশ্রমের প্রবেশ করেই যে গাছটি দেখা যাবে সেটি তমাল। আর মন্দিরের পাশে যে গাছটি সেটি মাধবীলতা। ভক্তদের কাছে মহাপূজনীয় এ গাছ দুটি।

যখন ফুলে-ফুলে সুশোভিত হয় চারপাশ, তখন ভক্ত হৃদয় উদ্বেলিত হয় ঠাকুর হরিদাস আর অদ্বৈত মহাপ্রভুর নামভজনে, স্মৃতি রোমন্থনে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ