সরেজমিনে ঘুরে জোরালো ধারণা পাওয়া গেল, রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলার ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে এমপিদের দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। প্রতিটি আসনেই নতুন মুখের সন্ধান দিচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা।
দিনাজপুর-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মনোরঞ্জল শীল গোপাল। তিনি প্রচুর দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ছাড়াও স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মনোরঞ্জল শীল গোপালকে এজন্য বড় মূল্য দিতে হতে পারে। মানে, নির্বাচনে তার কপাল পুড়তে পারে--এমন আভাস দিলেন অনেকেই। এদের মধ্যে সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে নেতাকর্মীরাও আছেন।
অনেকে এমন কথাও বলেছেন, এ আসনে এবার প্রার্থী বদল না করা হলে আসনটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তা চলে যেতে পারে জামায়াত নেতা মওলানা মোহাম্মদ হানিফ’র হাতে। যদি তিনি জোটের প্রার্থী হয়ে দাঁড়ান তাহলে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি নৌকার ভোটও নাকি পাবেন—এমনটাই দাবি করছেন এরা।
দিনাজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সংসদ সদস্য মনোরঞ্জল শীল গোপাল ছাড়াও রয়েছেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আবু হুসাইন বিপু, বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকারিয়া জাকা, বীরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম, বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শিবলী সাদিক।
অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী বীরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জামায়াত নেতা মওলানা মোহাম্মদ হানিফ ও বিএনপি’র মুঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু।
এই দু’জনের মধ্যে মোহাম্মদ হানিফ পরিচ্ছন্ন ইমেজের লোক হিসেবে পরিচিত। তার প্রতি নাকি সাধারণ ভোটারদের আস্থা বেশি। তারপরও তরুণ নেতা আবু হুসাইন বিপু নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলে তিনিও হতে পারেন এই কেন্দ্রের জন্য মূল ফ্যাক্টর। মূলত এ দুজনের ব্যাপারেই মানুষের আগ্রহ বেশি। সে তুলনায় মনোরঞ্জল শীল গোপালের নামটা মানুষের মুখে তেমন নেই এবার। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া বীরগঞ্জ-কাহারোলেও লেগেছে।
এসবের কারণ, জাগপা থেকে ডিগবজি দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া মনোরঞ্জন শীল গোপাল বীরগঞ্জ-কাহারোলে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ না করে বরং বিভক্ত করেছেন। তিনি দলটিতে দু’টি গ্রুপ তৈরি করেছেন। এর একটির নেতৃত্বে বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকারিয়া জাকা। অন্যটির নেতৃত্বে বীরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম। এই ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি আওয়ামী লীগকে দুর্বল করেছে। ভোটে এর বিরূপ প্রভাব না পড়ার কারণ নেই।
এলাকার কাজ ও দলীয় বিভিন্ন কাজেকর্মেও স্থানীয় নেতাদের আমলে না নেওয়ায় বিভেদ চরমে। যার প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচনেও।
এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিয়োগবাণিজ্য থেকে শুরু করে মদ-জুয়ার আসর বসানোরও। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে জামায়াত-বিএনপিকে কাছে টানার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
এমপি’র অনিয়মের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে একটি প্রতিষ্ঠান গড়া নিয়ে। বীরগঞ্জ প্রধান সড়কের পাশে একই প্রতিষ্ঠান তিনবার তিন নামে উদ্বোধন করেছেন। শোনা যায়, এজন্য নাকি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই সাংসদ। প্রথমে চক্ষু হাসপাতাল। সেটির আলোর মুখ দেখতে না দেখতেই নাম পরিবর্তন করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়। সেটিও ব্যর্থ হয়ে বর্তমানে ছেলের নামে দ্বীপ্ত ফাউন্ডেশন করার কথা বলে সরকারি অর্থ ব্যয় করছেন মনোরঞ্জন শীল গোপাল।
দলীয় এমপি’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শিবলী সাদিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুর্নীতি না করলে কিভাবে রাতারাতি মাটির ঘর থেকে বড় অট্রালিকা, বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন? স্ত্রীর নামে সন্তানের নামে এতো সম্পদ এলো কোথা থেকে?’
বিদ্যুতায়নের নামে গত ৫-৭ বছরে প্রায় ২ হাজার মিটার নতুন লাইন সংযোগের আগে প্রতিটি মিটার থেকে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা চাঁদা ওঠানোর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মনোরঞ্জন শীল গোপালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী নিজের কোনো জমি ছিল না। নিজের নামে নগদ অর্থ ছিল ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৮৫৭ টাকা। আর স্ত্রীর নামে ১০ লাখ ১০ হাজার ১২৭ টাকা।
জানা গেছে, বর্তমানে এমপি’র ১০০ বিঘা জমি রয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর সদরে একটি বাড়ি এবং কাহারোলে একটি বাড়ি। কলকাতার সল্টলেকে এবং শিলিগুড়িতেও বাড়ি বানিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। সবই নাকি এসেছে নিয়োগ-বাণিজ্য ও ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে।
আগামী নির্বাচনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভাবনা জানতে কাহারোল বাজারে কথা হয় মো. খলিল ও রেজাউল ইসলাম নামের দু’জন ভোটারের সঙ্গে।
মো. খলিল বলেন, এমপি সাহেব রাস্তাঘাট করেছেন। তবে কিছু কিছু কাজ খারাপ করেছেন। উনি প্রতিবছর মেলার নামে জুয়ার আড্ডা বসান। তাকে এলাকায় পাওয়া যায় না।
এবার ‘নৌকার মাঝি গোপাল হলে পাস করবেন জামায়াত নেতা হানিফ’ এমন কথা আরেক সাধারণ ভোটার রেজাউল ইসলামের মুখে। তিনি বলছিলেন, এবার মার্কা দেখে মানুষ ভোট দেবে না। আমাদের এখানে পৌরসভার মেয়র হানিফ খুবই ভাল মানুষ। উনি প্রার্থী হলে উনিই জিতবেন।
যুবলীগের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গোপাল এমপি পদে দাঁড়ালে আমাদের অনেক ভোটই হানিফের পক্ষে চলে যাবে।
দিনাপুর-১ আসনে নৌকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের একজন আবু হুসাইন বিপু। পরিচ্ছন্ন ইমেজধারী এই তরুণ নেতার ব্যাপারে সাধারণ ভোটারদের বেশ মনোভাব বেশ ইতিবাচক। অনেকের মুখেই এমন কথা শোনা গেল।
তাদের ধারণা, মনোরঞ্জন শীল গোপাল না দাঁড়িয়ে, বিপু দাঁড়ালে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থীর সঙ্গে এই আসলে রীতিমতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৭
এসএম