সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার তার ২০১৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় এমন তথ্যই দিয়েছিলেন।
তবে ওই হলফনামায় তার স্ত্রীর নামে কৃষি জমি ছিলো ৮ একর ১৮ শতাংশ।
ফিজার দিনাজপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য। এক কিংবা দুই বার নয় এই আসন থেকে ছয় বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
তারপরেও ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না, সে কথা হলফনামাই বলে দেয়।
কিন্তু এখন ফিজার মন্ত্রী হয়েছেন। আর মন্ত্রী হওয়ার পর তার মাটির ঘরটি হয়েছে বহুতল ভবন। হয়েছে খামার বাড়ি, স্ত্রী-কন্যা-ভাইয়ের জন্য আলাদা আলাদা গাড়ি।
ছয় ছয়বার ভোট দিয়ে তাকে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন ফুলবাড়ী-পার্বতীপুরের মানুষ। কিন্তু তাতে গণমানুষের উন্নতি কি কিছু হয়েছে?
সে চিত্র দেখতেই বাংলানিজের এই প্রতিবেদক সরেজমিন সফর করেন ফুলবাড়ি-পার্বতীপুর এলাকা।
সেখানে গিয়ে সাধারণের সাথে কথা বলে যা জানা গেলো তাতে লোকমুখে বলাবলি এমনটাই- জনগণের উন্নয়নের চেয়ে নিজের উন্নতিই বেশি করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার।
নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারি, স্কুল-কলেজ কমিটি, ইন্সুরেন্স বাণিজ্য এসব অনেক কিছুই এখন ফিজার পরিবারের পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
কারণ স্ত্রী আর ভাইদের নামেই তিনি এসব চালাচ্ছেন।
তবে এলাকাবাসী সেসব বুঝতে পারে, এমনটাই ধারণা পাওয়া গেলো ওই এলাকার বিভিন্ন আড্ডা আলোচনা থেকে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা থেকে দেখা গেছে, ফিজারের সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। স্ত্রীর নামে দিনাজপুর শহরে একটি বাড়ী আছে যার বাৎসরিক আয় ভাড়া থেকে ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৮৫ টাকা।
হলফনামায় তিনি ঠিকানা হিসেবে দিয়েছিলেন বাসা/হোল্ডিং ১৬/২৪, গ্রাম/রাস্তা পশ্চিম গৌরিপুর, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর। যে বাড়িটিতে সে সময় মাটি দিয়ে গাঁথুনিতে তৈরি টিনের ঘর ছিল।
এর আগে ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভূমিপ্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। তখনও তার সহায়-সম্পদ এত ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখেননি এলাকাবাসী।
কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের পর তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। যার বছর খানেক পরেই পুরোনো টিনের বাড়িটি ভেঙ্গে ওঠে বহুতল ভবন।
১০ তলা ফাউন্ডেশনের এবাড়িটি পাঁচ তলা পর্যন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। যা কঠিন শীলা দিয়ে তৈরি।
বাড়ির সামনের অংশ ও আন্ডারগ্রাউন্ডের একটা অংশ ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর পেছনের অংশে মন্ত্রী ফুলবাড়ী গেলে থাকেন।
পুরো বাড়িটি নির্মিত হয়েছে ১৪ শতাংশ জমির ওপর।
এছাড়া ফুলবাড়ী শহরের উত্তরে দিনাজপুর রোডে শিবনগর ইউনিয়নের ফকিরপাড়ায় প্রায় ২৪ একর জমির ওপর একটি খামার বাড়িও হয়েছে ফিজারের।
সেখানে নতুন আরেকটি বহুতল ভবন নির্মিয়মান রয়েছে। আর খামার বাড়ির ভেতরে রয়েছে আমের বাগান ও গরুর খামার।
বিশ্বস্তসূত্রে জানাগেছে, মন্ত্রীর এ সব সম্পদের প্রায় পুরটাই এসেছে নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন কমিশন থেকে। নিয়োগের বিষয়ে তার স্ত্রী রেহিনা রহমান ময়নাই অর্থ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি মন্ত্রীর স্ত্রী ও কন্যার আলাদা দু'টি গাড়িও হয়েছে। এছাড়া ভাই মুশফিকুর রহমান বাবুলও একটি গাড়ি কিনেছেন।
সূত্র জানায়, মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী হওয়ার পর ফুলবাড়ীতে সানরাইজ ও প্রোগ্রেসিভ ইন্স্যুরেন্সের শাখা খোলেন বাবুল। যেখানে প্রায় প্রতিটি স্কুলের শিক্ষককেই ইন্স্যুরেন্স করাতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।
মন্ত্রীর আরেক ভাই মোহাম্মদ ইমামুল পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল কাটার সব কাজ পেয়ে যান। তিনিও কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।
পাশাপাশি রয়েছে স্কুল কলেজের কমিটির সভাপতির পদ। যা থেকেও আসে অর্থ। এই কাজও চলছে পারিবারিকভাবে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে মন্ত্রী নিজে ফুলবাড়ী-পার্ববতীপুরের অন্তত দশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে রয়েছেন। ফুলবাড়ী আদর্শ কলেজ, খাজাপুর ফাজিল মাদ্রসা, আমবাড়ি ডিগ্রি কলেজ, ভবানীপুর ডিগ্রি কলেজ, পর্বতীপুর আদর্শ কলেজ, বছিরবানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, জমিরের হাট উচ্চ বিদ্যালয়, ও মনমতপুর ডিগ্রি কলেজ এমনই কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও বদলী থেকে অর্থ আসে।
মন্ত্রীর ভাই বাবুল সুজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সভাপতির পদ ছেড়েছেন সম্প্রতি। আর বর্তমানে খয়েববাড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদে রয়েছেন তিনি।
মন্ত্রির স্ত্রী ময়না সভাপতির পদে রয়েছেন আমবাড়ি ফাজিল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজে। আরেক ভাই এনামুল রয়েছেন রুদ্রানী স্কুল ও রামেশ্বপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি।
অভিযোগ মিললো, ফুলবাড়ী উপজেলার সামনে কোয়ালিটি ফাউন্ডেশন প্রাইমারি স্কুল নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবসরপ্রাপ্ত ২০ সরকারি কর্মকর্তা গড়েছিলেন। মন্ত্রী সেটাও নিজের নামে করে নিয়েছেন।
একজন এই অভিযোগও করলেন, মন্ত্রীর নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে জামায়াত-বিএনপিও ঢুকে পড়ছে সুবিধা মতো। আরও সুনির্দিষ্ট করে তিনি জানান, জামায়াতের কর্মী মো. মোবিদুল ইসলামকে ভবানীপুর ডিগ্রি কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগে সহায়তা করেছেন মন্ত্রী নিজেই।
এছাড়া নবগ্রাম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে মৌলানা নবীউল ইসলামকেও নিয়োগ পাইয়ে দিয়েছেন, যিনি ফুলবাড়ী উপজেলা বিএনপির জামায়াত ঘেঁষা বলেও পরিচিতি আছে।
এছাড়া মন্ত্রী মেয়ের জামাই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সকল নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। আর ভাই বাবুল কয়লা খনিতে বিভিন্ন ব্যবসা কব্জা করে নিয়েছেন একথা এখন দিনাজপুর-ফুলবাড়ীর মানুষের মুখে মুখে।
এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, মন্ত্রী হওয়ার পর মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সব উন্নয়ন কেবল নিজের পরিবারের জন্য করেছেন। কিন্তু এলাকার উন্নয়ন তেমন কিছু করেননি।
মোস্তাফিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। প্রায় সকল কমিটি তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই ভয়ে কেউ কিছু বলতেও পারেন না।
তবে এ বিষয়ে ফুলবাড়ী ও দিনাজপুরের একাধিক নেতা বাংলানিউজকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রীর দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কাজেই তার বিকল্প খোঁজার সময় এসেছে।
তারা বলছেন, মন্ত্রী গত সাত বছর নেতা-কর্মী-সমর্থকদের চেয়ে নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। যে কারণে তিনি জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি।
অনেকের কাছে এই প্রশ্নও বড় হয়ে দেখা দিয়েছেন, আবারও প্রার্থী হলে হলফনামায় এবার কি দেখাবেন মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৯ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৭
ইইউডি/এমএমকে