জেলা সদরের রথখলা এলাকার বাসিন্দা মিঠামইনের মানুষ অ্যাডভোকেট শেখ ফারুক আহমদ এমন তথ্য জানিয়ে বললেন, ‘হাওরের ৫০ ভাগ মানুষ বসবাসের নানা সুবিধা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে কিশোরগঞ্জ বা ঢাকায় থাকেন। হাওরের ভোটের চিত্র ও রাজনীতি উভয় স্থানের বিরাজমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে জানতে হবে।
সম্ভবত এ কারণেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কিশোরগঞ্জ শহরে। তার আসনের সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতির জেষ্ঠ্য পুত্র প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকও হাওরাঞ্চলে যাওয়ার এবং ফেরার পথে একদিন করে কিশোরগঞ্জে অবস্থান করেন।
বলা বাহুল্য, কিশোরগঞ্জের রাজনীতি বহুলাংশে হাওর-নির্ভর। জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বও বর্তমানে হাওরের মানুষের হাতে। ফলে হাওরের ভোটের তাপ শুধু জলমগ্ন গ্রামেই নয়; শহরেও পড়েছে। হাওরের গ্রাম আর শহরের সদর মিলেই চলছে ভোটের আলাপ এবং নেতা-কর্মীদের জনসংযোগ কার্যক্রম।
‘কিন্তু হাওরাঞ্চলে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী বলে যাকে বলা হচ্ছে, সেই ফজলুল রহমান জনসংযোগের এই দায়িত্বটি পালন করেন না। কিশোরগঞ্জ শহরে তার কোনও বেস নেই। এমন কি, প্রলয়ঙ্করী বন্যার ভয়াবহ দুর্যোগের সময়েও তিনি বিএনপির কেন্দ্রিয় টিমের সঙ্গে একদিন এসে মাত্র একবেলা ইটনা ঘুরে চলে গেছেন। অন্যত্র কোথাও যান নি। বিপদগ্রস্ত কৃষকের পাশে গিয়ে দাঁড়ান নি। ’ ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন সাংস্কৃতিক কর্মী-সাংবাদিক হাসান চুন্নু।
‘ফজলুর রহমান এসেছিলেন বটে। তবে সেটা তার অর্জনের চেয়ে বিসর্জন হয়েছে। ’ বললেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রভাষক এ. বি. সিদ্দিক। অষ্টগ্রাম বাজারে দেখা হলে তিনি বলেন, ‘স্যার, ছুটিতে আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। আমাদের পরিবার-পরিজন আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য অন্যান্য বারের চেয়ে আমি বাড়িতে অধিক সময় কাটাচ্ছি। শুনেছি ফজলুর রহমান ইটনা ঘুরে গেছেন মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। ইটনার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এবং অষ্টগ্রাম বা মিঠামইন একবারের জন্যেও আসেন নি তিনি। এখানকার মানুষ তা ভালো ভাবে নেয় নি। মানুষ এজন্য ক্ষুব্ধ ও হতাশ। ’
ইটনার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মকর্তা স্বাভাবিক কারণেই নিজের নাম উহ্য রেখে বলেন, ‘বিএনপি নেতার অনুপস্থিতিতে তৌফিক সাহেব হাওরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে ফেলেছেন। মাসের মধ্যে ১৫/২০ দিনই তিনি এলাকায় থাকেন। জরুরি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি না থাকলে তিনি হাওরের কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান মিস করেন না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘এমপি সাহেব এলাকায় বেশি থাকায় ও ঘন ঘন আসায় বিভিন্ন অফিসের লোকজন বিনা ছুটিতে আগের মতো কাজে ফাঁকি দিতে পারেন না। তার উপস্থিতিতে বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি-অনিয়ম হওয়ার সুযোগ কমেছে। ’
বস্তুত, হাওরাঞ্চলের ভোটের হাওয়া স্পষ্টভাবে বইছে তরুণ তৌফিক আর প্রবীণ ফজলুকে ঘিরে। উন্নয়ন ও জনসংযোগের মাধ্যমে হাওরে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন তৌফিক। ‘অবহেলিত হাওরের রাজনীতিকে তিনি উন্নয়নমুখী করেছেন। ’ স্থানীয় সাংবাদিকদের কথাতেও তা জানা গেল। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী ফজলুর রহমান মূলত অপেক্ষা করছেন রাজনৈতিক পালাবদলের জন্য। ’ এমনই মনে করেন অনেকেই। কারো কারো মনে সংশয়ও রয়েছে, ‘আদিতে আওয়ামী লীগ থেকে কাদের সিদ্দিকীর দল ঘুরে বিএনপিতে আসার ফলে ডিগবাজির ঐতিহ্য দিয়ে ভবিষ্যত রাজনীতিতে আস্থা, জনসমর্থন ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা সহজ হবে না তার পক্ষে। ’
কিশোরগঞ্জ জেলার মধ্যে হাওরাঞ্চলের ভোটের রাজনীতিতে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বেশ স্পষ্ট। এখানে বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচন করার জন্য অধিক প্রার্থীর দৌরাত্ম্য নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীতা নিয়েও কোন্দল বা গ্রুপিং-এর আঁচ পাওয়া যায় না। সরাসরি লড়াই হবে মুখোমুখি দুই প্রার্থীর মধ্যে।
‘হাওরাঞ্চলে একটি বিষয় সন্তর্পণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ভোটের আগে আগে’ একটি বিশেষ ধরনের বিষয়ে আভাস দিলেন চারিগ্রামের তোজাম্মেল হোসেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বেশির ভাগ সময় গ্রামেই থাকেন, যদিও কিশোরগঞ্জ শহরে নিজস্ব বাসায় তার পরিবার-পরিজন থাকেন। তার মতে, ‘হাওরের জনসংখ্যা সাধারণভাবে দুইটি ভাগে বিভক্ত। এই বিভাজন সাংস্কৃতিকভাবে দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। একদিকে রয়েছে আবাদী বা বহিরাগত মানুষ আর অন্যদিকে জংলি বা স্থানীয় মানুষ। ভোটের সময় প্রার্থীর ঐতিহ্যগত সূত্র ও পরিচিতি কোন দিকে থাকে, তার ওপর ভোটারদের সমর্থন বা বিরোধিতার একটি প্রভাব কাজ করে। ’
‘বিষয়টি একদা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন মোটেও নয়’, কলেজ ছাত্র ফয়সাল ইস্যুটি নাকচ করে দিয়ে বললেন, ‘৪০/৫০ বছর আগে এই আদিম ও বর্বর মানসিকতা তীব্রভাবে ছিল। তখন শিক্ষা, দীক্ষা ও সচেতনতা মানুষের মধ্যে কম ছিল। মানুষকে তখন আঞ্চলিকতা বা জাত-পাতের ভিত্তিতে স্বার্থান্বেষী মহল উত্তেজিত করে ভোটের রাজনীতি করত। ’
জানতে চাইলাম, ‘এই ইস্যুটি ভোটের সময় কার্যকর হবে কি না?’ এবং প্রশ্নটি করেছিলাম, হাওরের বাইরে লোক হয়েও হাওরের নানা বিষয়ে কাজ করেন এমন একজন সাংস্কৃতিক-উন্নয়ন সংগঠকের কাছে। ‘না, এটা কোনও সমস্যাই নয়। এখন সব বাসিন্দাই বৃহত্তর হাওর সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণভাবে হাওরাঞ্চলের সকল মানুষের অভিন্ন পরিচিতি হলো ‘ভ্যাইট্টা’। অবহেলিত ভাটী অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে ঐক্যবদ্ধ হাওর পরিচিতিকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা এখন কার্যকর হবে না। এমন আত্মঘাতী চিন্তা সুবিধাবাদী ও প্রাচীনপন্থিরা করলেও শিক্ষিত-তরুণ-যুবকরা করে না। ’ বললেন হাওরের জীব-প্রাণি বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা নিয়ে কার্মরত অ্যাক্টিভিস্ট ও গবেষক সারাফ নাওয়ার। মূলত চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও সারাফ নাওয়ারের কর্মক্ষেত্র বৃহত্তর হাওরের সুনামগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব পর্যন্ত। ‘প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অপার সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার জনপদের দুর্ভাগ্য ও অবহেলা মোচন করে উন্নয়ন-অগ্রগতির নবযুগের সূচনা করতে মানুষ একজন ‘শক্তিশালী ভ্যাইট্টা নেতা’কেই চাইবেন আগামী নির্বাচনে। ’ বললেন তিনি, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বার বার বিপদাক্রান্ত হয়ে হাওরবাসী বিভেদ নয়, ঐক্য-অগ্রসরতা-সমৃদ্ধিকেই গুরুত্ব দেবেন বলে আমার ধারণা। ’
উন্নয়ন যে হাওরের সর্বত্র একটি বহুল প্রত্যাশিত বিষয় এবং সামনের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে, সেটা প্রায়-সবাই স্বীকার করেন। ‘নির্বাচনের লড়াইটা হবে উন্নয়ন ও রাজনীতির’, উল্লেখ করে ইটনা সমিতির একজন সদস্য মন্তব্য করেন, ‘তৌফিক উন্নয়ন-অগ্রগতির দিক থেকে নানা কাজের মাধ্যমে এগিয়ে আছেন। ফজলুর রহমান রাজনৈতিক বক্তব্য ও আবেগ দিয়ে ভোটারদের মনোরঞ্জন করতে চাইবেন। ’ পাবলিক লাইব্রেরির হলরুমে ভোটের এমন বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হলেন না আরেক সদস্য, ‘কাজ ছাড়া শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য ও আবেগ ফল আনবে না। মানুষ এখন অনেক সচেতন ও হিসাবি। কথা ও কাজের মিল না থাকলে এবং কথায় মিথ্যাচার, উস্কানি ও চরিত্রহননের নোংরা উদ্দেশ্য থাকলে সাধারণ মানুষ সেসব আর গ্রহণ করে না। ’
রাজনীতিতে তৌফিককে পেছনে ফেলে দেওয়া মোটেও সম্ভব হবে বলে মনে করেন না অভিজ্ঞজনেরা। হাওরাঞ্চলের অধিবাসী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ-প্রবীণ আইনজীবী বাংলানিউজকে বলেন, ‘একাধিক বার যে আসন থেকে পিতা নির্বাচিত হয়েছেন, তৌফিক সাহেব নিজেও সেখানে পর পর দুইবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। পিতার ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতা এবং নিজের তারুণ্যময় গতিশীলতার মিশেলে তিনি এলাকার রাজনীতিক কার্যক্রম যোগ্যতার সঙ্গেই চালাচ্ছেন এবং নবীনে-প্রবীণের সমন্বয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের তৃণমূল কমিটি ও নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে তিনি হাওরাঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম কাণ্ডারিতে পরিণত হয়েছেন। মানুষের কাছে তিনি পিতার যোগ্য উত্তরাধিকার রূপে সমাদৃত। ’
একজন প্রকৌশলী হলেও রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক শুধু নিজের এলাকাতেই নন, জেলার রাজনীতিতে প্রবলভাবে আবির্ভূত হয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থী হিসাবে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ ও সমর্থন লাভ করেছিলেন। একদার সাংবাদিক ও কিশোরগঞ্জের অধুনালুপ্ত একটি দৈনিকের অন্যতম সম্পাদক প্রকৌশলী তৌফিক কিশোরগঞ্জে আধুনিক স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের অন্যতম রূপকার ও উদ্যোক্তা। স্বচ্ছ ইমেজ, ভালো ব্যবহার, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শৈল্পিক মননের জন্য হাওরের জনগণের মধ্যে উন্নয়নমুখী এই ‘শক্তিশালী ভ্যাইট্টা নেতা’র আবেদন দিনে দিনে বাড়ছে। ‘মানুষের কাছে তার ক্রমবর্ধমান দৃঢ় অবস্থান টলানো খুব সহজ হবে না’, বলে মন্তব্য করে হাওরাঞ্চলের সোসাল নেটওয়ার্ক-এ তৎপর অন-লাইন অ্যাক্টিভিস্ট জাফরি ফারুক বলেন, ‘পরিকল্পিত কাজের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক ধরে রাখতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে তিনি পিতার মতোই বিকল্পহীন নেতায় পরিণত হবেন। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৭
জেডএম/
কিশোরগঞ্জ-২: উন্নয়নহীনতায় ক্ষুব্ধ ভোটার