অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর একাধিক প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই বেসামাল প্রধান এই দুই রাজনৈতিক দল। প্রার্থীরা কেউ কাউকেই ছাড় দিতে রাজি নন।
জানা যায়, মহানগরীর খালিশপুর, দৌলতপুর ও খানজাহান আলী থানা নিয়ে গঠিত খুলনা-৩ আসন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী দু’জনই দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য। বেগম মন্নুজান সুফিয়ান খুলনা-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এবং সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী। অন্যদিকে এস এম কামাল হোসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। এই দুই নেতার পক্ষেই বিভক্ত ওই এলাকার কর্মীরা।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এস এম কামাল। খালেককে বিজয়ী করতে তার কৌশলী ভূমিকায় তিনি তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন।
খুলনার দৌলতপুর দিবা-নৈশ কলেজে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও অর্থবাণিজ্যের অভিযোগ এনে ২০১৫ সালে কলেজটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মন্নুজান সুফিয়ানের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা হয়। এছাড়া বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ভাইয়ের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। আর এতে বর্তমান সংসদ সদস্যের জনপ্রিয়তায় অনেকটা ভাটা পড়েছে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইছেন এস এম কামালের সমর্থকরা।
এস এম কামাল বাংলানিউজকে বলেন, দল যদি মনোনয়ন দেয় আমি নির্বাচন করবো। আমাদের প্রতিটি ওয়ার্ডে নেতাকর্মীরা সংগঠিত আছে। দলকে ঐক্যবদ্ধ করে এ নির্বাচনকে আমরা মোকাবেলা করবো। গত দশ বছরে এই সরকার দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। মানুষ ভোট দিবে শেখ হাসিনার উন্নয়ন দেখে। বিশেষ করে বিএনপির আমলে খালিশপুর, দৌলতপুর শিল্পাঞ্চলে যেসব কলকারখানা বন্ধ ছিল বর্তমান সরকার সেগুলো চালু করেছে। শ্রমিকদের মজুরি দিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসার উন্নয়ন করেছে।
কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে নমিনেশন (মনোনয়ন) পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নমিনেশন দেওয়ার মালিক দলের সভানেত্রী। তবে আমি নমিনেশন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। যাচাই-বাছাই করে দলের সভানেত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন আমি মেনে নেবো। মনোনয়ন না দিলেও দলকে সুসংগঠিত রেখে কাজ করবো। আর দিলে তো নির্বাচন করবো ইনশাআল্লাহ।
দুই দিন ধরে বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
এদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারও প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করছেন মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এক সময়ের শিল্পাঞ্চলের ডাকসাইটে নেতা কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম। তার সঙ্গে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন আরও তিন নেতা। তারা হলেন- মহানগর বিএনপির প্রথম যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তারেক রহমানের ঘনিষ্ট রকিকুল ইসলাম বকুল এবং মহানগর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ও খালিশপুর থানা সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান মিঠু ।
খুলনার খালিশপুর, দৌলতপুর, খানজাহান আলী থানায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার সম্বলিত পোস্টার, ব্যানার এবং ফেস্টুন টানিয়েছিলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুল। এছাড়া নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে সম্প্রতি স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করেছেন তিনি।
তৃণমূল একাধিক নেতা বলছেন, তারেক রহমানের খুবই আস্থাভাজন বকুল। তিনি এ আসনের সংসদ সদস্য হলে এলাকার অনেক উন্নয়ন হবে।
কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম ও অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুজ্ব, হারাচ্ছেন কর্মী সমর্থক। তবে আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে সক্রিয় অবস্থানে তারিকুল ইসলাম।
অন্যদিকে আরিফুর রহমান মিঠুর দীর্ঘদিন ধরে মহানগর বিএনপির সভাপতির সঙ্গে একটি দ্বন্দ্ব চলছে। মিঠু নির্বাচনী এলাকায় আলাদা কর্মসূচি পালন করছেন।
রকিবুল ইসলাম বকুল বাংলানিউজকে বলেন, আগে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারপর নির্বাচনের কথা নিয়ে ভাবনা। ছাত্রজীবন থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে ছিলাম, আছি। খুলনা-৩ আসনে নির্বাচন করার জন্য সব প্রস্তুতি রয়েছে আমার।
অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এমন কোন কর্ম দিবস নেই যেদিন আমার আদালতে হাজিরা দেওয়া লাগে না। এমন কোন আন্দোলন নেই যেখানে আমি সক্রিয় ভূমিকা রাখি না। জেল, জুলুম, নির্যাতন, হামলা-মামলায় আমার থেকে অন্য কোনো সহকর্মী যদি বেশি ভূমিকা রাখেন তবে আমি প্রার্থী হবো না। ৮ ফেব্রুয়ারি যেদিন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় রায় দিয়ে জেলখানায় নেওয়া হয় সেদিনও আমি রাজপথে নেমে গ্রেফতার হই। খুলনাতে আমার চেয়ে বেশি মামলা কোন সিনিয়র নেতারও নেই।
আরিফুর রহমান মিঠু বাংলানিউজকে বলেন, মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। আমাদের আন্দোলনের প্রস্তুতিও আছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিও আছে।
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই আসনে মহানগর শাখার সভাপতি মাওলানা মুজাম্মিল হককে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের কারও এ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে না।
এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, খুলনার শিল্পাঞ্চলখ্যাত এই আসনটি এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে ধরে রাখতে পারেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনে এই আসন থেকে আ’লীগের মমিন উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির হাসিনা বানু শিরিন নির্বাচিত হন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপি থেকে বিজয়ী হন তৎকালীন যুগ্ম-মহাসচিব মো. আশরাফ হোসেন। ১৯৯৬ সালে এই আসন থেকে বিজয়ী হন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম। অবশ্য পরে তিনি আবার বিএনপিতে ফিরে যান। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বিজয়ী হয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি আবার বিজয়ী হন।
খুলনা জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্যানুযায়ী, খুলনা-৩ আসনে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৬ হাজার ৭০৫। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭১২ এবং মহিলা ভোটার ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮৫।
বাংলাদেশ সময়: ০৬০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
এমআরএম/জেডএস